একটি সময় ছিল যখন দেশের উপকূলীয় এলাকায় বিশাল আকারের কচ্ছপ ঘুরে বেড়াত। স্বাধীনভাবে মনের খুশিতে প্রকৃতিতে ছিল তাদের অবাধ বিচরণ। সাগরের তীরে বালুর ভেতরে ডিম দিত, সেই ডিমে বাচ্চা জন্মাত। সেসব আজ কেবলই স্মৃতি। এখন আর চোখে পড়ে না বাটাগুর বাসকা প্রজাতির কচ্ছপ। বলা যায়, কচ্ছপের এ প্রজাতিটি আজ প্রায় বিলুপ্ত। অথচ এক সময় পৃথিবীতে উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারেই বসতি ছিল বাটাগুর বাসকার (স্থানীয় নাম শালগম, সাদামুখী কাইঠ্ঠা, মান্দারী কচ্ছপ)। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয় ও নানামুখী কারণে এরা প্রকৃতি থেকে আজ বিলুপ্তপ্রায়। আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন (আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ) এ প্রজাতির কচ্ছপকে মহাসঙ্কটাপন্ন প্রাণীর তালিকায় স্থান দিয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, সব শঙ্কা কাটিয়ে আবারো বীরদর্পে প্রকৃতিতে ফিরবে হারিয়ে যাওয়া কচ্ছপ বাটাগুর বাসকা।
অস্ট্রিয়ার জুভিয়ানার অর্থায়নে টার্টাল সারভাইভাল অ্যালায়েন্সয়ের প্রযুক্তিগত সহায়তায় গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে নিবিড় অঞ্চলে এই প্রজাতিকে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দিতে চলছে ‘প্রজেক্ট বাটাগুর বাসকা’ প্রকল্প। যে প্রকল্পে চলছে প্রজনন ও গবেষণা কার্যক্রম। এতে সহযোগী হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশের বন বিভাগ এবং প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন। প্রকল্পের গবেষক এ জি জে মোরশেদ জানান, এই প্রজাতির নারী কচ্ছপ পৃথিবীতে আছে মাত্র ১৬টি। এর মধ্যে ৮টি বাংলাদেশে, ২টি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মাদ্রাজে ও ৫টি দেশটির সুন্দরবন এলাকায় এবং অস্ট্রিয়ার গ্রাদে-এ রয়েছে ১টি। আমাদের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে মোট ৪টি নারী বাটাগুর বাসকা প্রজাতির কচ্ছপ আছে। গত বছর মার্চ ও এপ্রিল মাসে এসব কচ্ছপের বাসা থেকে ১২৯টি ডিম পাওয়া গিয়েছিল। এ বছরেও ৬৩টি ডিম পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ২০১২ সালে ২৬টি, ২০১৩ সালে ৬১টি, ২০১৪ সালে ৪৮টি, ২০১৫ সালে ১১টি বাচ্চা পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে কোনটি নারী বা কোনটি পুরুষ— তা শনাক্ত করতে ১৫ বছর সময় লাগবে।
জানা গেছে, সম্প্রতি ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান থেকে ৪টি ফিমেল বাটাগুর বাসকা কচ্ছপ সুন্দরবনের করমজলে একই প্রজেক্টের আওতায় অপর গবেষণা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে প্রজনন কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর সেখান থেকে এখন পর্যন্ত ৫৮টি বাচ্চা পাওয়া গেছে। পরিচর্যাকারী হাসানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনি পরম যত্নে এ কচ্ছপগুলোকে দেখাশোনা করেন। নিয়ম করে খাবার দেন।
গবেষকদের তথ্যানুসারে, এ প্রজাতির কচ্ছপের ডিমগুলো ২৭-২৯ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রার মধ্যে থাকলে তা থেকে পুরুষ বাচ্চার জন্ম হয়। অপরদিকে, ২৯-৩৩ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে তা থেকে নারী বাচ্চার জন্ম হয়। বছরে সেপ্টেম্বর মাসে বাটাগুর বাসকা প্রজাতির প্রজনন ঘটে। মার্চ-এপ্রিলে ডিম দেয়। প্রজননের আগে পুরুষ কচ্ছপের শরীরে এক দৃষ্টিনন্দন পরিবর্তন ঘটে। প্রজননকালে এদের শরীরের নরম অংশ গোলাপি রঙ ধারণ করে। এ প্রজাতির কচ্ছপগুলোর মধ্যে নারীদের দেহের আকার পুরুষের আকারের চেয়ে বড় হয়ে থাকে। এরা মূলত তৃণভোজী হলেও গবেষণা কেন্দ্রে এদের শাকসবজির পাশাপাশি তাজা চিংড়ি, শুকনা চিংড়ি, ছোট শামুক দেওয়া হয়। সবজির মধ্যে এরা মিষ্টিকুমড়া, টমেটো, কচুশাক ও বাঁধাকপি খায়। তবে কলমি শাক এদের সবচেয়ে পছন্দের খাবার।
বন বিভাগের ওয়াইল্ড লাইফ সেন্টারের সরীসৃপবিদ সোহেল রানা বলেন, মহাসঙ্কটাপন্ন বাটাগুর বাসকা (কচ্ছপ) প্রকল্প আশার আলো দেখাচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে প্রকৃতিতে আবারো বাটাগুর বাসকার অবাধ ফিরবে আশা করছি। এ নিয়ে বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন সংরক্ষক জাহিদুল কবির বলেন, প্রকল্পটি এখনো পর্যন্ত খুব ভালো কাজ করে যাচ্ছে। আমরা আশানুরূপ প্রজনন (বাচ্চা) পাচ্ছি। আশা করি, মহাসঙ্কটাপন্ন বাটাগুর বাসকা প্রজাতির কচ্ছপ আবারো স্বাভাবিক সংখ্যায় প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।