এস এম সামছুর রহমান, বাগেরহাট প্রতিনিধি :
মাত্র ৮ মাস বয়য়ে পিতার নিরুদ্দেশ যাত্রা, এরপর নদী কেড়ে নেয় শেষ সম্বল ঘরটি। প্রতিকুল পরিবেশ, সীমাহীন দারিদ্রতা ও নদীর সাথে যুদ্ধ করে এখন তিনি ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান। তিনি হচ্ছেন, মোংলা উপজেলার চাঁদপাই ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান অর্পা মল্লিক। একই সাথে নিজেকে শিক্ষিত করে তোলা ও একজন সফল অপরাজিতা জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে পরিচয় করিয়েছেন নিজের দক্ষতায়। তবে এই সাফল্যের পথ কখনই মসৃন ছিল না, ছিল কন্টকাকৃর্ন।
সরেজমিনে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, দেশের দক্ষিনের বাগেরহাট জেলার সুন্দরবন সংলগ্ন মোংলা উপজেলার চাঁদপাই ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডে দক্ষিণ কাইনমারি গ্রাম। সুন্দরবন থেকে এই গ্রামটিকে আলাদা করেছে প্রমত্তা পশুর নদী। এই পশুর নদীর পাড়েই দরিদ্র একটি খ্রিস্টান পরিবারে জন্ম হয় অর্পা মল্লিকের। বাবা ছিলেন সিনেমা হলের টিকিটম্যান। অর্পার জন্মের মাত্র ৮ মাস পর বাবা তার মাকে ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়। অন্ধকার অমাবশ্যার রাতেই যেন প্রচন্ড ঝড় শুরু হয় তাদের উপর। তার মা পশুর নদীতে জাল টেনে মাছ ধরে ও অন্যের বাড়ি কাজ করে কোন ভাবে খেয়ে না খেয়ে জীবন চলতে থাকে তাদের।
স্থানীয় স্বপ্না মল্লিক জানান, ছোট বেলা পিতা তাদের ছেড়ে চলে যায় অজানায়। ছোট্ট অর্পাকে নিয়ে তার মা পড়েন বিপাকে। একেতো সংসারে দরিদ্রতা তার উপর ছোট্ট অর্পাকে নিয়ে কোথায় যাবেন তিনি। স্থানীয়দের সহায়তায় পরের বাড়ি কাজ করে অর্পাকে বড় করে তোলেন তার মা। এক পর্যায়ে শিশু অর্পা নিজেই মায়ের সাথে নদীতে নেমে মাছ ধরা শুরু করে।
প্রতিবেশি কবিতা মল্লিক জানান, তিনি স্থানীয় ভাবে মাছ ক্রয় করে পাইকারদের কাছে বিক্রি করতেন। অর্পা ও তার মা নদীতে জাল দিয়ে মাছ ধরে তার কাছে বিক্রি করতো। অনেক সময় আগে টাকা নিয়ে চাল-ডাল কিনে আনতো তারা।
চাঁদপাই ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান অপারাজিতা অর্পা মল্লিক বলেন, ৪/৫ বছর বয়ষে মায়ের সাথে নদীতে নামা শুরু করেন তিনি। একদিকে সকালে স্কুলে যাওয়া, সেখান থেকে ফিরে নদীতে মাছ ধরা। এক পর্যায়ে স্থানীয় অন্যন্য পরিবারের মত তাদের শেষ সম্বল ঘরটুকুও প্রমত্তা পশুর নদী গ্রাস করে নেয়। সরকারী রাস্তার পাশে ছোট একটি কুড়েঘর বেধে মা-মেয়ে থাকা শুরু করেন। ‘প্রমত্তা পশুর নদী ঘরবাড়ি কেড়ে নিলেও, তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ’ আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন অর্পা মল্লিক।
স্থানীয় সুষময় সরকার জানান, অর্পার জীবনে অনেক ঘাতপ্রতিঘাত গেছে। তবে মেধাবী এই মেয়েটি কোন কিছুর কাছে হার মানে নি। শত কষ্ট ও দারিদ্রতাকে জয় করেছে সে।
অর্পা মল্লিক বলেন, একদিকে স্কুলে যাওয়া, নদীতে মাছ ধরা ও ছেলে-মেয়েদের টিউশনির পাশাপাশি স্থানীয় মিশনারী স্কুলে সামান্ন পয়সার পড়ানো শুরু করেন তিনি। সেই ছোট বেলা থেকে মানুষের দুঃখ দেখলে তার মন কেঁদে উঠতো। তাই মিশনারী স্কুলে স্থানীয় ছোট্ট শিশুদের তিনি অনেক আদর করে নামমাত্র বেতনে পড়াতেন। একর্যায়ে স্থানীয়রা অর্পাকে বিয়ে দেন এক ঘের ব্যবসায়ীর সাথে।
অপরাজিতা অর্পা মল্লিকের স্বামী কিউবার্ট মৃধা বলেন, বিয়ের পর স্ত্রীকে উচ্চ শিক্ষা ও জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে সহযোগীতা করেছেন তিনি। স্ত্রীর কোন চাওয়াকেই তিনি অপূর্ণ রাখেন নি। এভাবে প্রত্যেক স্বামীর উচিৎ স্ত্রীর পাশে দাড়ানো।
স্থানীয়রা অর্পা মল্লিককে ২০২১ সালে বিপুল ভোটের ব্যবহানে চাঁদপাই ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য নির্বাচিত করেন, পরে প্যানেল চেয়ারম্যান মনোনীত হন। এরপর বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা রুপান্তরের অপরাজিতা নারী নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষন নিয়ে নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তোলেন।
সাফল্যের এই চাবিকাঠি পেতে অনেক কাটার আঘাত পেরিয়ে আসতে হয়েছে তাকে। তবে দমে যাননি তিনি। অদম্য মনের শক্তি ও নিজের প্রতি বিশ্বাস তার পথকে করেছে সহজ। আরো নারীরা তাকে দেখে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে বলেন অপরাজিতা অর্পা মল্লিক।
চাঁদপাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোল্লা মো: তারিকুল ইসলাম জানান, নিজের চেস্টায় অর্পা আজ এখানে উঠেছে। সে যেমন উচ্চ শিক্ষিত তেমনি বিনয়ী। তাই সে প্রথম বার ইউপি সদস্য নির্বাচিত হলেও তাকে প্যানেল চেয়ারম্যান করা হয়েছে। তাকে দেখে নারী সমাজের শিক্ষা নেয়া উচিৎ।
অপরাজিতা নারী নেটওয়ার্কের বাগেরহাট জেলা শাখার সাধারন সম্পাদক রিজিয়া পারভিন বলেন, অর্পা মল্লিক সুন্দরবনের পাশে দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়ে, ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আজ যেখানে এসেছেন তা অনেক কঠিন বিষয়। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাড়ানো ও নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে অর্পা মল্লিকের মতো নারীরা বিশেষ ভুমিকা ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন এই নারী নেত্রী।