• শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪২৮

সারা দেশ

অবহেলা-অযত্নে ধ্বংসের পথে ৫০০ বছরের পুরোনো টাকশাল

  • ''
  • প্রকাশিত ০৪ এপ্রিল ২০২৪

সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি:

অযত্ন আর অবহেলায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে সোনারগাঁ পৌরসভার আমিনপুরে অবস্থিত ৫’শ বছর আগের টাকশাল। অভিযোগ উঠেছে, অসিম দাস গুপ্ত নামে স্থানীয় এক স্কুলের শিক্ষক ৪৮১ শতাংশ এ জমিটি ধমীর্য় উপসনালয় তৈরি করে দখলে রেখেছেন। যদিও অভিযুক্ত অসিম দাস গুপ্ত জমিটি তার পৈত্রিক বলে দাবি করেছেন। আর স্থানীয়দের দাবি, প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের আওতায় না থাকায় বেহাল হয়ে যাচ্ছে ৫’শ বছরের পুরোনো এ ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখাগেছে, সোনারগাঁ পৌরসভার আমিনপুর এলাকায় পানাম সিটির উত্তরে অবস্থিত টাকশালের যে বাড়িটি তা ‘ক্রোড়ি বাড়ি’ নামে পরিচিতি। বাড়িটির চার দিকে শ্যাওলা যুক্ত পুরোনো চওড়া দেয়ালের সাথে বাড়ির প্রবেশ ফটক লাগোয়া তৈরি করা হয়েছে নতুন গেইট ও দেয়াল। গেইটে লিখা রয়েছে ১৮০৫ সালের তৈরি। ভেতরে প্রবেশ করতেই ফটকের সামনে দাড়িয়ে থাকা একটি মন্দিরের আদলে তৈরি দ্বিতল ছোট স্থাপনা। ওই দ্বিতল স্থাপনার অদূরে পশ্চিম পাশে আরও একটি বড় আকৃতির দ্বিতল বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। যতটুকু দাড়িয়ে আছে ততটুকুর দেয়ালের প্রতিটি জায়গায় শোভা পাচ্ছে ছোট ছোট গর্তের ন্যায় কুঠোরি। যেখানে এক সময় মুদ্রা বা মুদ্রাজাতীয় কিছু সংরক্ষণ করা হতো বলে সহজেই অনুমেয়।

এই দুই স্থাপনার পাশে রয়েছে সদ্য তৈরি আরও দুইটি ঘর। একটি কাঁঠ ও টিনের তৈরি। অপরটি সিমেন্ট ও টিনের। ফটক দিয়ে প্রবেশ করতে যে ছোট দ্বিতল স্থাপনাটি রয়েছে সেখানে রং দেয়ার কাজ করছিল তিনজন ব্যক্তি। প্রতিবেদককে দেখেই একটু কাচুমাচু ভঙ্গিতে নড়েচড়ে বসেন তারা। প্রশ্ন করতেই কিছু জানেনা বলে উত্তর আসে। পরক্ষণেই আসেন এক ব্যক্তি। নাম জানতে চাইলে জানান, সুমন। যিনি নিজেকে এই বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন বলে জানান। কিন্তু বাড়িটির মুল মালিক পৈতৃক ওয়ারিশ সূত্রে অন্য একজন আছেন।

সুমন জানান, জমিটির মালিক মৃত অমল দাস গুপ্ত। অসিম দাস গুপ্ত নামে স্থানীয় একটি স্কুলের এক শিক্ষক উত্তরাধিকার সূত্রে ভোগ করছেন। যিনি মৃত অমল দাস গুপ্তের সন্তান।

তিনি জানান, একটি দাগে বাড়িটি মোট ৪ একর ৮১ শতক (৪৮১ শতাংশ)। যার মধ্যে একটি সুন্দর বড় দিঘিও রয়েছে। দিঘিটির চারপাশে রয়েছে প্রাচীন আমলের তৈরি সানবাঁধানো ঘাট। পুকুরের পাড়ে বিভিন্ন ফলদ গাছ। বাড়ির পশ্চিমে দ্বিতল ভবন। যার ধ্বংসাবশেষ মাটিতে পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ধ্বংসাবশেষের কিছু অংশ আঁকড়ে ধরে কোনরকম  ঝুলে আছে উপড়ে পড়া মোটা গাছের শিকরের সাথে। দেখলে বুঝার উপায় নেই, ‘প্রাকৃতিক বৈরিতায় না—কি কোন লালসায় মানুষ্যসৃষ্ট কৃত্তিম দুর্যোগে এই অবস্থা’।

স্থানীয় একজন জানায়, কিছুদিন আগেও গাছের সাথে লেগে থাকা ধ্বংসাবশেষের জায়গায় ছিল একটি পুরোনো ভবন। যা এখন শুধুই স্মৃতি। বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্বে থাকা সুমন জানান, বড় দিঘিসহ বাড়িটি

৪৮১ শতাংশের মধ্যে কিছুটা অংশ নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি মামলা চলছে। স্থানীয় পৌরসভা অধিগ্রহণ করে সেখানে পৌরভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিলে বিষয়টি মামলায় গড়ায়।

এ বিষয়ে কথা হয় বর্তমান জমিটি নিজেদের পৈত্রিক সম্পত্তি দাবি করা স্থানীয় জি.আর ইনস্টিটিউশন স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক অসিম দাস গুপ্তের সাথে। তিনি জানান, জমিটি এসএ, আরএস অনুযায়ী তার স্বগীর্য় দাদার নামে। পরবতীর্তে ১৯১২ সালের দিকে তার বাবার নামে এসএ রেকর্ড করান। পরবতীর্তে ১৯৫০ সালের দিকে তার বাবা পরলোকে গেলে তিনি পৈত্রিক ওয়ারিশ সূত্রে জমিটি দেখভাল করছেন।

তিনি দাবি করেন, এখানে অনেক পুরোনো একটি শিব মন্দির আছে। যেখানে পুজাঅর্চনা করা হয়। এ সময় প্রতিবেদক মন্দিরটি অনেক পুরোনো নয় এবং প্রতিবেদকের কাছে থাকা স্থিরচিত্র ও ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট যে, মন্দিরটি বর্তমান সময়ে করা। জমিটি তার দখলে রাখতে এটিকে মন্দির হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন প্রশ্নের জবাবে কিছুটা নিরব থেকে তিনি বলেন, মন্দিরটি সম্প্রতি সংস্কার করা হয়েছে। তবে, বেদখল নয়, জমিটি তার পৈত্রিক বলেই দাবি করেন। পাশাপাশি এখানে কোন টাকশাল ছিল, তা তিনি কখনো শোনেননি বলেও দাবি করেন।

দেশী—বিদেশী ইতিহাসে এ স্থাপনাটি টাকশাল হিসেবে বিবেচিত। ইতিহাস অস্বীকার করার উপায় তার (অসীম দাস গুপ্ত) আছে কি-না এমন প্রশ্ন করলে তিনি আবারও কিছুটা নিরব থেকে বলেন, আমিতো ইতিহাস পরি নাই। ইতিহাসে কি আছে জানিনা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক এলাকাবাসীর দাবি, ধমীর্য় উপসনালয়ের নামে অসীম দাস গুপ্ত দীর্ঘ দিন ধরে ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী টাকশালের জমিটি নিজের দাবি করে ভোগ দখল করছেন। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার বিভিন্ন পত্র—পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলেও যথাযথ কতৃপক্ষ কোন রকম ব্যবস্থা নেয়নি। স্থানীয় ইতিহাসবিদদের দাবি, ৫’শ বছরের পুরোনা টাকশালের স্থাপনাটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাধীন থাকার কথা থাকলেও কোন এক অদৃশ্য কারণে তা ব্যক্তিমালিকানাধীন হয়ে উঠছে।

সোনারগাঁয়ের ক্রোড় বাড়ি বা টাকশাল ইতিহাস:

‘সোনারগাঁ’ প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ বড় একটি স্থান দখল করে আছে স্বগৌরবে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে অদ্যবধি সোনারগাঁয়ের সুনাম বিশ্বব্যাপী। সোনারগাঁ প্রাচীন বাংলার রাজধানী হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন সময় এখান থেকে শাসন করেছেন উপমহাদেশের বহু বাঘা—বাঘা শাসক।

তাদের শাসনকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে সোনারগাঁ থেকে এক সময় নিজস্ব মুদ্রারও প্রচলন হয়েছিল। তৎকালীন রাজন্যবর্গ মুদ্রা তৈরীর জন্য সোনারগাঁয়ে গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব মুদ্রাগার বা টাকশাল।

সোনারগাঁ পৌরসভার আমিনপুর ও জামপুর ইউনিয়নের মহজমপুর এলাকায় পৃথক দুটি টাকশাল ছিল বলে ধারণা করেন ইতিহাসবিদরা। যদিও জামপুরের টাকশালের কোন অস্তিস্ব এখন আর অবশিষ্ট নেই।

বিশিষ্ট সাংবাদিক,লেখক, কলামিষ্ট ও ইতিহাসবিদ শামসুদ্দোহা চৌধুরী তার “সোনারগাঁয়ের ইতিহাস” বইয়ে ‘সোনারগাঁয়ের ক্রোড় বাড়ি’ অংশে উল্লেখ করেন, সম্রাট শেরশাহের সময় সোনারগাঁয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থা উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিল। ১৫৭৪ খ্রি: সম্রাট আকবর ১৮২ জন ক্রোড়ি (মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে পরগনার রাজস্ব অধিকর্তা ও রাজস্ব সংগ্রাহকের পদবি ছিল ক্রোড়ি) নিয়োগ করেছিলেন। সর্বসাধারণের নিরাপত্তার জন্যে তিনি শিকদার ই শিকদারান এবং রাজস্ব কর্মকর্তা ও বিচারক “আমিন—ই—মুলক” পদের সৃষ্টি করেন।

ঐতিহাসিক স্বরূপচন্দ্র রায় তার ‘সুবর্ণগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “শামসুদ্দিন আবুল মোজাফফর শাহ” এর নামাঙ্কিত মুদ্রা সোনারগাঁওয়ে মুদ্রিত হয়েছিল।

ঐতিহাসিক ব্রাডলি বার্ট তার বিখ্যাত গ্রন্থ রোমান্স অব এ্যান ইস্টার্ন ক্যাপিটাল” এ সোনারগাঁয়ের ‘ক্রোড় বাড়ি’র কথা উল্লেখ করেছেন। শামসুদ্দোহা চৌধুরী তার “সোনারগাঁয়ের ইতিহাস” বইয়ে এই ক্রোড় বাড়িটি শেরশাহ ও সম্রাট আকবরের সময় ‘ট্রেজারার হাউজ’ নামে পরিচিত ছিল বলে উল্লেখ করেন।

স্থানীয় ইতিহাসবিদদের মতে, সোনারগাঁয়ের টাকশাল দুটির মধ্যে মহজমপুর এলাকার টাকশাল ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেলেও কোন রকমে টিকে আছে সোনারগাঁ পৌরসভার আমিনপুর টাকশালটি। যদিও এই টাকশালটিতে থাকা প্রায় ৫শ’ বছর পুরোনো টাকশাল ভবনের প্রায় ৬০ ভাগই প্রাকৃতিক বিভিন্ন বৈরিতা বা মানুষ্য লোভ—লালসায় কৃত্রিম সংকটে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। বাকি যতটুকুরই অস্তিত্ব আছে তাও ধমীর্য় উপাশনালয়ের নামে বেদখলের পায়তারা করছে।

কি বলছেন লেখক ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ:

বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক ও সংগঠক শাহেদ কায়েস জানান, শুধু সোনারগাঁ নয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু পুরোনো ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ভূমিদস্যূদের থাবায় বেদখল হয়ে যাচ্ছে। সোনারগাঁয়ের টাকশাল ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এখানে সম্রাট আকবর ও শেরশাহের আমলে মুদ্রা তৈরি হতো। যে মুদ্রা তৎকালীণ উপমহাদেশের বণিকসহ সকল শ্রেণীর মানুষ আদান—প্রদান করতো। কিন্তু কোন অদৃশ্য কারণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনাকে তাদের আওতায় নিচ্ছেনা আমার জানা নেই। তবে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদাসিনতায় যে এ সকল গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ভুয়া দলিলের মাধ্যমে বেদখল হচ্ছে তা নতুন কিছু নয়। হয়তো এর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়।

এক প্রশ্নের জবাবে সোনারগাঁ পানাম সিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিয়াম চৌধুরী জানান, তিনি এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন প্রায় বছর দুই হবে। লোকমুখে শুনেছেন টাকশালের কথা। সম্প্রতি সেখানে গিয়েছেনও। তিনি জানান, কিছুদিন আগেও একটি ভবন দাড়িয়ে ছিল যা এখন নেই। তবে, যেহেতু ভবনটি প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের আওতায় নয় সেহেতু এ বিষয়ে তিনি আপাতত কিছুই করতে পারবেনা। তবে, কোন সভা হলে এটি অধিদপ্তরের আওতায় আনা যায় কি—না তা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাবেন।

নারায়ণগঞ্জ জেলা মোঃ মাহমুদুল হক জানান, সম্প্রতি তিনি নারায়ণগঞ্জে নিয়োগ হয়ে এসেছেন। ইতিহাসে সোনারগাঁয়ের টাকশালের বিষয়ে জেনেছেন কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত নন। এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে পরবর্তী করণীয় কি তা দেখবেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads