• শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪২৮

সারা দেশ

শ্রীপুরে শাপলা ফুলেই অন্ন জোটে ৩শ পরিবারের

  • প্রকাশিত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আতাউর রহমান সোহেল, শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি:

থৈ-থৈ জলরাশিতে ভেসে আছে সাদা- লাল রঙের শাপলা।সৌন্দর্য বাড়ানোর পাশাপাশি জীবিকারও সুযোগ সৃষ্টি করেছে জাতীয় ফুল শাপলা। বর্ষা শুরুর পর শ্রাবণ থেকে অগ্রহায়ণ পর্যন্ত গাজীপুরের কাপাসিয়া ও শ্রীপুর উপজেলার নলগাঁও, প্রহলাদপুর, ডুমনী, লক্ষ্মীপুর—এই চার গ্রামের কমপক্ষে ৩০০ পরিবার শাপলা বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করেন।সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে সাদা- লাল রঙের শাপলা। নৌকায় বিলের পানিতে ভেসে ফুলের সাথে মিলে মিশে যান দর্শনার্থীরা।

শাপলায় ভরে উঠেছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার প্রহলাদপুর ইউনিয়নের ডুমনী গ্রামের টেইননার বিল।যতদূর চোখ যায়- রক্তিম হাতছানি। বিলের পানিতে মাথা উঁচু করে সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে সাদা- লাল শাপলা।প্রকৃতির এই রূপ দেখার জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে দিনভর ভিড় করছেন দর্শনার্থীরা। বছেরর তিন মাস এই যায়েগাটি ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে থাকে। সরকারি ছুটির দিনে শাপলার বিলে ভিড় বেড়ে যায়।ওইদিন দর্শনার্থীরা পরিবার-বন্ধু-স্বজনদের নিয়ে বিলে নৌকায় বেড়িয়ে শাপলার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করে।শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। কথা হয় ডুমনী গ্রামের ইলিয়াস সহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁরা জানিয়েছেন, আশপাশের আরও দু–একটি গ্রামের অনেক নারী-পুরুষ ও শাপলা তুলে জীবিকা নির্বাহ করেন।

তবে ডুমনী গ্রামে এটাকে পেশা হিসেবে নেওয়া নারীর সংখ্যা বেশি।এখানে শাপলা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিন শতাধিক পরিবার।বিল থেকে সংগ্রহ করেন পরিবারের পুরুষেরা আর শাপলা প্রক্রিয়াকরণের সিংহভাগ কাজ করেন নারীরা। এ কাজে তাদের কোনো পুঁজির দরকার হয় না। বর্ষা মৌসুমে বিল-ঝিলের বিস্তীর্ণ জলাভূমি জুড়ে প্রচুর শাপলা ফোটে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে জীবিকার তাগিদে মানুষগুলো ছুটে যান জলাভূমি থেকে শাপলা তোলার জন্য। শাপলা তুলে ভরদুপুরে সব শাপলা একসঙ্গে করে বাজারে বিক্রি করেন। আর এই আয় থেকেই চলে তাদের সংসার।বছরের অন্যান্য সময় কৃষি কাজে ব্যস্ত থাকলেও বর্ষার সময়টাতে এসব মানুষের হাতে কোনো কাজ থাকে না। তখন জীবন ধারণ করা কার্যত অনেক কষ্টকর হয়ে পড়ে। এই সময়টাতে শাপলা বিক্রি করে পরিবারের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিন কাটায় দরিদ্র মানুষগুলো। আষাঢ় থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত বিলে প্রচুর শাপলা ফোটে।

আর এ সময়টাতে তারা অন্যান্য সময় থেকে বেশি শাপলা তুলতে পারেন। পানি যত গভীর সেখানকার শাপলা তত ভালো হয়। উপজেলার বিভিন্ন বিল-ঝিল ঘুরে দেখা যায়, চারপাশে এখন অথৈ পানি। ডিঙি নৌকা দিয়ে কেউ বিলে মাছ ধরছে কেউবা আগাছা পরিষ্কার করে নৌকা নিয়ে বিলের গহীনে যাচ্ছেন শাপলা তুলতে। আবার কেউ বিল থেকে শাপলা তুলে জমা করছেন নৌকায়। নৌকায় করে শাপলা এনে বাজারে বিক্রি করার জন্য মহাসড়কের পাশে স্তূপ করে রাখছেন তারা। কয়েক বছর ধরে শাপলা তুলে জীবিকা নির্বাহ করা ইলিয়াস জানান, বর্ষা মৌসুমে কাজ না থাকাই শাপলা তুলে বাজারে বিক্রি করি। অন্য সময় থেকে এ সময়টাতে খুব স্বচ্ছলভাবে চলতে পারি।

বর্ষার মৌসুমে প্রতিদিন সকালে আমরা কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে শাপলা তুলতে যাই। প্রতিটি দলে ১০-১২ জন সদস্য থাকে। প্রতি দল মিলে দুই আড়াইশ কুড়ি (প্রতি কুড়িতে ৮০-১০০টি) শাপলা তুলতে পারি। আর এতে আমাদের জনপ্রতি দৈনিক ৮শ-১ হাজার টাকা আয় হয়, যা বছরের অন্য সময় থেকে বেশি। বছরের অন্য সময়টাতে সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয়, কিন্তু এ সময়টা আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। ডুমনী গ্রামের আমেনা খাতুন জানান,শাপলা ফুলের পুরোটাই কাজে লাগে। তবে সাদা শাপলা বিক্রি করা যায় না। কেবল লাল শাপলা বিক্রির উপযোগী। বিল থেকে শাপলা তোলার পর ফুলের মাথার অংশ ডাঁটা থেকে কেটে আলাদা করা হয়। ফুলকে কেটে চার ভাগ করা হয়। এরপর ডাঁটাগুলোকে বাঁশের আড় বা অন্য কোনো উঁচু স্থানে বিছিয়ে দেওয়া হয় রোদে শুকানোর জন্য।

শাপলা শুকানোর জন্য তিন দিন রোদ লাগে। প্রতিদিন এক নৌকায় যে পরিমাণ শাপলা ওঠানো যায়, সেখান থেকে ৯–১০ কেজি শুকনা শাপলা পাওয়া যায়।একই গ্রামের জুলেখা বেগম বলেন, ‘টেইননার বিল ছাড়াও বারোবাইয়া, বৈঠা কালি, রৌয়ের বন বিল থেকে প্রচুর লাল শাপলা তুলি আমরা। একই গ্রামের শাপলা বিক্রেতা দীপ্তি রানী জানালেন তাঁর স্বামী কৃষিজীবী। শাপলা বিক্রি থেকে যে আয় হয়, তা সংসারে বড় ভূমিকা রাখে। তিনি পাঁচ বছর ধরে অন্তত প্রতি মৌসুমে ৫০ হাজার টাকা আয় করেন। তিনি বলেন, ‘শাপলার বিলে বড় নৌকা চালানো যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। তাই ছোট তালের গাছ দিয়ে তৈরি “কোন্দা” (কায়াকের মতো একধরনের দেশি নৌকা) দিয়ে শাপলা তুলতে যেতে হয়।ডুমনী গ্রামে এসে শ্রীপুরের বেশ কয়েকজন পাইকারি ব্যবসায়ী ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে শুকনা শাপলা কিনে নিয়ে যান বলে জানালেন ডুমনীর আনোয়ারা বেগম।

তাঁদের গ্রামে ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে শাপলা বিক্রি চলছে। পাইকারি বিক্রেতা এই শাপলা কিনে নিয়ে আরও বেশি দামে ভেষজ ওষুধ তৈরির বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রি করেন। ডুমনীর শাপলার বড় একজন ক্রেতা মো. আইনুল হক। রাসেল স্টোর নামে ভেষজ উপকরণ সরবরাহের দোকান আছে তাঁর। দেশের বিভিন্ন ভেষজ ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে তিনি লাল শাপলাসহ অন্তত ১০০ ধরনের ঔষধি গাছগাছড়া ও উপকরণ সরবরাহ করেন। আইনুল হক বললেন, ‘ডুমনী গ্রামের শতাধিক নারীর কাছ থেকে প্রতিবছর ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকার উপকরণ কিনি। বাংলাদেশে কেবল শ্রীপুরের ডুমনী এলাকা থেকেই লাল শাপলা সংগ্রহ করি।

এ প্রসঙ্গে শ্রীপুর উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ সুমাইয়া সুলতানা বন্যা বলেন, শাপলা প্রাকৃতিকভাবে পুরাতন বিল-ঝিলে জন্মে। এর চাষ পদ্ধতি এখনো প্রচলিত হয়নি। শাপলা ফুল সাধারণ সবজি থেকে অনেক বেশি পুষ্টিগুণে ভরপুর। এতে আলুর চেয়ে সাতগুণ বেশি ক্যালসিয়াম থাকে। এ্যালার্জি, চর্মরোগ, আমাশয়, অ্যাসিডিটিতেও এটা বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখে। মানসিক রোগেও এর ব্যবহার করা হয়। ফলে সবজী হিসেবে বাজারে এর চাহিদাও রয়েছে অনে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads