সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে এক পক্ষকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উত্তপ্ত থাকল। প্রতিষ্ঠানটির উপাচার্যের বাড়ি পুড়ল। রাজনৈতিক শিবিরে নানা বিভক্তি ঘটল। অথচ সেই কোটা বিষয়ে এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো নির্দেশনা জারি হলো না। কবে নাগাদ প্রজ্ঞাপন জারি হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারছেন না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা। এতে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতিও নেই। ফলে চাওয়া-পাওয়ার দোলাচলে আন্দোলনকারীরা। হতাশা থেকে তাদের মধ্যে বাড়ছে ক্ষোভও। অথচ কোটা আন্দোলনের উত্তপ্তাবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে জানান, সরকারি চাকরিতে কোনো কোটা পদ্ধতিই থাকবে না। তার ওই ঘোষণার ১২ দিন পার হচ্ছে আজ।
এদিকে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল না করে সংস্কার করার পক্ষে মত দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত হওয়া কমিটির বৈঠকে এই মত বেরিয়ে আসে।
কমিটির সভাপতি আশিকুর রহমান বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিলের কথা বলেছেন ঠিকই। কিন্তু আমাদের কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে। এই দায়বদ্ধতা বিবেচনা করে আমরা কোটা পদ্ধতি সহজিকরণের কথা বলেছি। যুক্তিযুক্ত সংস্কারের কথা বলেছি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, তাদের কাছে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা না থাকায় কোটা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেলে কাজ শুরু করবেন তারা। তবে এর আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোজাম্মেল হক খান তার দফতরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন সেগুলো শুনেছি। তিনি কোটা পদ্ধতি বাতিল ঘোষণা করেছেন, আবার তিনি প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর স্বার্থ যাতে সংরক্ষিত থাকে সে বিষয়ে পৃথক ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বাসও দিয়েছেন। সব কোটা বাতিল হবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটা যখন প্রজ্ঞাপন জারি করব, তখন স্পষ্ট করব।
তবে মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, আজ সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডন থেকে দেশে ফিরবেন। এরপরই তিনি এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে কোনো নির্দেশনা দিতে পারেন। মূলত কোটা সংস্কার নিয়ে কী এবং কোন ধরনের নির্দেশনা জারি হবে- সে বিষয়টি নিয়ে সবাই প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন।
ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতৃত্বে সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা। টানা চার দিনের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের অন্যভাবে চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। তার এ ঘোষণায় আন্দোলন এক মাসের জন্য স্থগিত করে শিক্ষার্থীরা।
এদিকে এই আন্দোলন আর যাতে দানা বাঁধতে না পারে সেজন্য নানামুখী ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি আন্দোলনকারীদের তিন নেতাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ডিবি। তাদের ছেড়ে দেওয়া হলেও সবার মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ ও ক্ষোভ কাজ করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আন্দোলনকারী এক শিক্ষার্থী বলেন, কোটা নিয়ে যাতে আর কোনো আন্দোলন গড়ে উঠতে না পারে সেজন্য ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। নিরাপত্তা জোরদারের নামে হলগুলোতে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। কাউকে কাউকে হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকিও আসছে।
এক সময় ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশ নিলেও আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেক শিক্ষার্থীকে ছাত্রদল-শিবির প্রমাণে মরিয়া একটি পক্ষ। ফলে আতঙ্কে হল ছাড়ছে অনেক শিক্ষার্থী। আবার কেউ কেউ নিজেকে বিপদমুক্ত রাখতে এখন আন্দোলনকারীদের বিপক্ষে স্ট্যাটাস দিচ্ছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ও সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে মোবাইল ফোন তল্লাশি করে গভীর রাতে সুফিয়া কামাল হল থেকে তিন ছাত্রীকে বের করে দেয় প্রশাসন। এরপর তীব্র সমালোচনার মুখে তাদের হলে ফিরিয়ে এনেছে প্রশাসন। ক্যাম্পাসে বাড়ানো হয়েছে ছাত্রলীগ ও প্রশাসনের নজরদারি। হলে হলে আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের তালিকাও তৈরি করা হচ্ছে গোপনে। আন্দোলনের পক্ষে যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম লিখেছে তাদেরও চিহ্নিত করা হচ্ছে।
আবাসিক এক শিক্ষার্থী বলেন, সব সময় আতঙ্কের মধ্যে থাকি। দিনের বেলায় হলে থাকি না। রাতে হলে আসার পর আতঙ্ক বেশি কাজ করে। মাস্টার দা সূর্য সেন হলের এক শিক্ষার্থী জানান, হলে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বড় ভাইয়েরা আগের মতো আচরণ করছেন। তবে ভয় কাটছে না। এমন চিত্র অন্য হলগুলোতেও। তবে বেশি ভীতি ছড়িয়েছে কবি সুফিয়া কামাল হলে।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, হলে হলে আন্দোলনকারীদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নীরব। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও মাস্টার দা সূর্য সেন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল। তিনি বলেন, প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সভা হয়েছে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা যেকোনো মূল্যে নিশ্চিত করা হবে। যাতে স্থিতিশীল পরিবেশ থাকে সেজন্য হলে হলে কাউন্সেলিং করা হবে।
প্রসঙ্গত, সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটার সংস্কার চেয়ে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে আন্দোলন শুরু করে। ৮ এপ্রিল শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশের লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার কারণে আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। এর জের ধরে সারা দেশেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দেয়, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ঘোষণা না আসা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। এ অবস্থায় ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিলের পক্ষে মত দেন। এই ঘোষণার পর প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি স্থগিত করে আন্দোলনকারীরা। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষিত। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার স্বজনদের জন্য ৩০, নারী ১০, জেলা ১০, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫, প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ।