চলতি বছরের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় পাসের হার বাড়লেও এক লাখ ২৩ হাজার ৫৩৩ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ কম পেয়েছে। গত বছরের চেয়ে গড়ে এ বছরের ফলাফল ভালো হলেও সিলেট বোর্ডে ৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং দিনাজপুর বোর্ডে পাসের হার কমেছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এ ছাড়া গত বছর কুমিল্লা বোর্ডে ৬২ দশমিক ৮৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করলেও এবার তা এক লাফে ২৪ দশমিক ১৬ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৮৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এবার প্রথমবারের মতো বাংলা ও ইংরেজি নতুন সিলেবাসে অর্থাৎ ক্লাসে বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় এবং ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র নামে আলাদা দুটো বিষয় পড়লেও পরীক্ষা দিতে হয়েছে ১০০ নম্বরের। এতে শিক্ষার্থীরা কিছুটা কম নম্বর পেয়েছে। পাশাপাশি বাংলা বিষয়েও শিক্ষার্থীরা নম্বর কম পেয়েছে। অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, অলিগলিতে গজিয়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের কাছে ধরা খেয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফলাফল। এবার ৩৭ হাজার ২০৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৩ লাখ ৮০ হাজার ৫৮ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। যার পাসের হার ৯৮ দশমকি ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ৩৬ হাজার ১৪৫ জন। আর ২২ হাজার ২০২টি কিন্ডারগার্টেনের তিন লাখ ৮৩ হাজার ১০৭ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে পাস করেছে ৯৮ দশমিক ৯২ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ১১ হাজার ৫৩৬ জন। গত বছরের চেয়ে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা এবার প্রায় এক লাখ বেড়েছে।
গতকাল সোমবার পরীক্ষা দুটির ফল প্রকাশের পর বিশ্লেষণে এসব তথ্য জানা গেছে। এমন তথ্য পেয়ে বিশ্লেষকরা নানাভাবে বিষয়গুলো বিশ্লেষণের চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে কিন্ডারগার্টেন স্কুল যেভাবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে গিলে খাওয়ার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে। তবে প্রাথমিকের মন্ত্রী থেকে কর্মকর্তা-সবাই গিলে খাওয়ার বিষয়টি না মেনে তারা বলেছেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় পড়েছে।
ফল প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ফলাফলের পরিসংখ্যান তুলে ধরার পর বলেন, বিশ্বের সঙ্গে সমন্বয় করে আমাদের দেশের পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এ কারণে ফলাফলে ছন্দপতন হচ্ছে। তবে এসব বিষয় আরো গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা দরকার। আগামী সরকার ক্ষমতায় এলে তারা বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখবেন বলেও মন্তব্য করেন। বোর্ডওয়ারি ফলাফল বিশেষ করে দুটি বোর্ডের পাসের হার কমে যাওয়া, কুমিল্লায় অস্বাভাবিক ফলাফলের কারণ জানতে চাইলে মন্ত্রীর মতে, এটি কেন ঘটল তা বোর্ডের চেয়ারম্যানরা খতিয়ে দেখবেন। তবে জিপিএ-৫ কমে যাওয়ার পেছনে তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, চতুর্থ বিষয়ের নম্বর যুক্ত না হওয়ায় জেএসসি পরীক্ষায় এ বছর জিপিএ-৫ কম পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। ধারাবাহিক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু হওয়ায় এ বছর জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় বোর্ডের ফল প্রক্রিয়াকরণে চতুর্থ বিষয় বিবেচনা করা হয়নি। এ কারণে গত বছরের তুলনায় এ বছর জিপিএ-৫ পাওয়া পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে।
ঢাকা বোর্ডের ফলাফল ঘেঁটে দেখা গেছে, জেএসসিতে গত বছর বাংলায় যেখানে ৯৯ দশমিক ০৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছিল। এবার পাস করেছে ৯৭ দশমিক ২ শতাংশ। গণিতে গত বছর পাস করেছিল ৯১ দশমিক ৪০ শতাংশ, সেখানে এ বছর পাস করেছে ৯০ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, শিক্ষার্থীরা বিষয়ওয়ারি গত বছরের চেয়ে ১-২ শতাংশ কম নম্বর পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। এতে ধরাছোঁয়ার বিষয় না। এ ছাড়া জিপিএ-৫ কমার বিষয়ে তিনি শিক্ষামন্ত্রীর মতোই বলেন, চতুর্থ বিষয়ের নম্বর বাদ দেওয়ার জিপিএ-৫ কমেছে। অর্থাৎ ক্লাসে শিক্ষার্থীরা চতুর্থ বিষয় পড়লেও পরীক্ষা হয়নি।
সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আবদুল কুদ্দুছ বলেন, সিলেট বোর্ডে গণিতে ফেল করার কারণে পাসের হার কম হয়েছে। এক পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বলেন, গত বছর যেখানে গণিতে পাস করেছিল ৯৬ দশমিক শূন্য শতাংশ, সেখানে এ বছর ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ কমে পাসের হার দাঁড়িয়েছে ৮৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। কেন গণিতে এই শিক্ষার্থীরা ফেল করল-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এবার গণিতের প্রশ্নটি একটু কঠিন হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা খারাপ করেছে। পরিস্থিতি উত্তরণে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হবে বলে তিনি জানান।
তবে অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, পরীক্ষা মানে পাস-ফেল। কেউ পাস করবে, আবার কেউ করে ফেল। তবে ফেল করলেই সব শেষ নয়, ফেল থেকেই সফলতার গল্পগুলো শুরু হয়। খুদে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাতেও পাস-ফেলের পরিসংখ্যান আছে। একবার ফেল করার মধ্যে তার (শিক্ষার্থীর) পুরো জীবন মূল্যায়ন করার কারণ নেই। কেউ যেন মন খারাপ করে বসে না থাকে।
প্রাথমিকের চেয়ে এগিয়ে কিন্ডারগার্টেন : প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে- দেশব্যাপী এবার পাসের হারে সব সরকারি স্কুলের চেয়ে এগিয়ে আছে কিন্ডারগার্টেনগুলো। এ বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে (পিইসি) পাসের হার ৯৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। আর ইবতেদায়িতে এ হার ৯৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এ দুই মিলিয়ে পাসের হার ৯৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। এবার ৩৭ হাজার ২০৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৩ লাখ ৮০ হাজার ৫৮ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। যার পাসের হার ৯৮ দশমকি ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ৩৬ হাজার ১৪৫ জন। অপরদিকে ২২ হাজার ২০২টি কিন্ডারগার্টেনের তিন লাখ ৮৩ হাজার ১০৭ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে পাস করেছে ৯৮ দশমিক ৯২ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ১১ হাজার ৫৩৬ জন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, শিক্ষার্থীরা বই পড়ছে, বইয়ের ভেতরে ঢুকেছে বলেই প্রাথমিকে জিপিএ-৫ প্রাপ্তি বেড়েছে। মন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি পরীক্ষা ভালো দিয়েছে তারা। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের মনোযোগ আরো বেড়েছে এটা ধরে নিতে হবে, ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকরা আরো সচেতন হয়েছে এবং পরীক্ষাটাকে গুরুত্ব দিয়েছে তারা।
শিক্ষার্থীদের বেসরকারি স্কুলের প্রতি আগ্রহের কারণ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, কিছু অভিভাবক এভারেজ স্ট্যান্ডার্ডের মধ্যে থাকতে চাচ্ছেন না। নাম শুনে মনে করছে এখানে (কিন্ডারগার্টেন)..., এখন তো পৃথিবীটা, আমরা গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দা, কেমন করে আমার ছেলেটা অন্য দেশে যেতে পারবে। তার জন্য মনে করে কিন্ডারগার্টেন শব্দটার মধ্যে একটা রোমাঞ্চ আছে। সেখানে পড়ালে তাদের ছাত্র-ছাত্রীরা বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে, ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে..., এটা মনে করছে হয়তো তারা। আমি মনে করি কিন্ডারগার্টেনে যারা পড়ছেন, কোনোটাকেই আলাদা করি না, সরকারি উদ্যোগে সব বিদ্যালয়। শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই কোটি, তার মধ্যে আমাদের প্রাইমারিতে এক-দেড় কোটি পড়ছে। এই যে ৫০ লাখ শিক্ষার্থী, মানুষের কিছুটা সচ্ছলতা বেড়েছে, কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা বেড়েছে। এখন গ্রামেও চলে গেছে। সরকারি স্কুলের তুলনায় বেসরকারি স্কুলগুলোর পাসের হার কিছুটা বেশি প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গড় হিসাবের ক্ষেত্রে কারা এগিয়ে বা পিছিয়ে সেটা রেজাল্টের পর পাওয়া যাবে। মন্ত্রী বলেন, আমাদের (সরকারি স্কুল) কেউ খেয়ে ফেলবে না। আমাদের পেটের মধ্যে ছোটখাটো অনেক কিছু আছে। সবাই চলে আসবে।
মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম আল হোসেন বলেন, ২০১৮ সালে অনেকগুলো পদক্ষেপ নেওয়ার ফল এবার প্রমাণ পেয়েছি। ২০১৯ সালে আমাদের কাজ হবে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার ভিত্তি তৈরি করা। সেজন্য অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।