সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ১৮ হাজারের বেশি মামলা বিচারাধীন। এসব মামলা নিষ্পত্তিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক না থাকায় গতকাল সোমবার তিনজন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নতুন এই নিয়োগে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনসহ বিচারকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাতে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আপিল বিভাগে বিচারকের সংখ্যা বাড়লেও বিদ্যমান মামলা নিষ্পত্তি কঠিন হবে। বিদ্যমান মামলার জট কমাতে আরো বিচারপতি নিয়োগ প্রয়োজন। অন্যথায় দুর্ভোগ কমবে না বিচারপ্রার্থীদের।
সর্বশেষ তথ্য বলছে, আপিল বিভাগে ১৮ হাজারের বেশি মামলা। ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত ১৮ হাজার ২৪৬টি মামলা আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে দেওয়ানি ১২ হাজার ৯৮৮ ও ফৌজদারি ৫ হাজার ২৫৮ মামলা।
অন্যদিকে প্রধান বিচারপতিসহ মাত্র চারজন বিচারপতি নিয়ে গতকাল সোমবার পর্যন্ত চলেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের কার্যক্রম। গত ২৩ বছরের মধ্যে এত কম বিচারপতি আপিল বিভাগে দেখা যায়নি। ১৯৯৫ সালে আপিল বিভাগে বিচারপতি ছিলেন মাত্র চারজন। গত কয়েক মাস ধরে আইনাঙ্গনে আপিল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগে নানা গুঞ্জনের মধ্যে গতকাল এ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেন হায়দার কর্মরত আছেন। নতুন নিয়োগ পাওয়া তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি জিনাত আরা, বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান। গত জানুয়ারি পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞার তিন মাসের মেয়াদে পাঁচজন বিচারপতি দিয়ে চলছিল আপিল বিভাগের কার্যক্রম। গত ২ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা পদত্যাগ করায় এই সংখ্যা নেমে আসে চারে। সেই থেকে গত ৮ মাস চার বিচারপতিতে চলেছে বিচারিক কার্যক্রম।
সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রজ্ঞাপন জারি করে বিচারপতির সংখ্যা ১১ জনে উন্নীত করে। এটাই ছিল আপিল বিভাগে স্বাধীনতার ৪৬ বছরে সর্বোচ্চ সংখ্যক বিচারকের সংখ্যা।
প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে স্বাধীনতার পর মাত্র তিনজন বিচারপতি দিয়ে শুরু হয়েছিল আপিল বিভাগের কার্যক্রম। পরে ১৯৭৪ সালে চারজন বিচারপতি কর্মরত ছিলেন। ২০০১ সাল পর্যন্ত বিচারকের সংখ্যা চার-পাঁচজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ২০০৩ সালে ৭ জন এবং পরের বছর ৮ জনে উন্নীত হয়। ২০০৯ সালে এই সংখ্যা একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে ১১ জনে উন্নীত করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার ত্বরান্বিত করতে। ২০১১ সালেও ১০ জন নিয়ে বিচারকাজ চলেছে আপিল বিভাগে। কিন্তু চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি ৪ জনে পৌঁছেছে এই সংখ্যা।
সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারপতিকে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তখন আপিল বিভাগে বিচারক ছিলেন ৯ জন। এর মধ্যে এক বিচারপতির মৃত্যু ও দুইজনের অবসর এবং দুইজনের আকস্মিক পদত্যাগে বিচারকের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় চারে।
গত বছর ১ জানুয়ারি চিকিৎসাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মারা যান বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান। তারপর গত চার মাসের ব্যবধানে অবসরে যান আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. নিজামুল হক নাসিম এবং বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ১৪ মার্চ বিচারপতি মো. নিজামুল হক নাসিম অবসরে যান। তারপর ৭ জুলাই অবসরে যান আপিল বিভাগের প্রথম নারী বিচারপতি এবং দেশের প্রথম নারী বিচারক বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। একই বছরের ১০ নভেম্বর পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তিনি সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনের মাধ্যমে বঙ্গভবনে পদত্যাগপত্র পাঠান, যা গৃহীত হয় ১৪ নভেম্বর। আর গত ২ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করা আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা। তারও আগে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে অবসরে যান বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।
আপিল বিভাগে বিচারক কমে যাওয়ায় গত বেশ কয়েক মাস সর্বোচ্চ আদালতের কার্যক্রম চলে একটিমাত্র বেঞ্চ দিয়ে। একসময় যখন ১১ জন বিচারপতি কর্মরত ছিলেন তখন তিনটি পৃথক বেঞ্চেও বিচারকাজ হয়েছে। আর পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ গঠিত হয়েছিল ১১ বিচারপতিকে নিয়ে। কিছুদিন আগেও দুটি বেঞ্চ ছিল।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বাংলাদেশের খবরকে বলেছেন, অতীতে আপিল বিভাগে তিনটি বেঞ্চের কার্যক্রম ছিল। বর্তমানে বিচারাধীন মামলা নতুন এ নিয়োগের মাধ্যমেও নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে না। এজন্য আরো বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।