একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের জয় দেখতে চান মামলার আলোচিত চরিত্র মো. জালাল ওরফে জজ মিয়া। এ মামলায় প্রথম তিনি প্রধান আসামি হলেও পরবর্তী সময়ে তাকে বানানো হয় সরকারপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। আবদুল কাহহার আকন্দের তদন্তে উদ্ঘাটিত হয় যে, জজ মিয়া প্রধান আসামি নন- গ্রেনেড হামলা করেছে অন্য কেউ। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন কর্মকর্তারা মূল ঘটনা ধামাচাপা দিতে শ্রমজীবী জজ মিয়াকে বলির পাঁঠা বানান।
একটি সূত্রের মাধ্যমে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জজ মিয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। এ সময় জজ মিয়া জানান, বর্তমানে তার পেশা ড্রাইভিং। একসময় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের গাড়ি চালাতেন। পরবর্তী সময়ে নিজেই গাড়ি কিনে ভাড়ায় চালান কিছুদিন। থাকেন নারায়ণগঞ্জের মিজমিজি এলাকায়। মাঝে একবার বিয়েও করেছিলেন রাজধানীর জুরাইন এলাকায়। পরে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। গত জানুয়ারিতে মা জোবেদা খাতুনের মৃত্যুর পর অনেকটাই একা হয়ে যান জজ মিয়া। তার ভাই আলমগীর মিয়া দনিয়া এলাকায় বসবাস করলেও তার সঙ্গেও যোগাযোগ নেই। জীবিকা নির্বাহের জন্য এখন গালফ সিকিউরিটি গার্ড সার্ভিসের গাড়ি চালান।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় হচ্ছে জেনে জজ মিয়ার কণ্ঠে উঠে আসে স্বস্তির স্বর। রায়ে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের জয় দেখতে চান। নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে আজকের রায় ঘোষণার সময় আদালতে থাকারও আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি।
সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ যারা তাকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে প্রধান আসামি বানিয়েছিলেন তাদের প্রত্যেকের ফাঁসি দাবি করেন জজ মিয়া। রায়ের পর খালেদা জিয়া, লুৎফুজ্জামান বাবর, রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, আবদুর রহিমসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করার আগ্রহের কথাও জানান তিনি।
দিনকাল কেমন যাচ্ছে- প্রশ্ন করা হলে জজ মিয়া বলেন, যাচ্ছে একরকম। প্রতি বছর ২১ আগস্টে অনেক ফোন পাই। সাংবাদিকরাও অনেক কিছু জানতে চান। রায়কে সামনে রেখে এবারো ফোন পাচ্ছি অনেক। কিন্তু যেই আমি সেই আমিই রয়ে গেছি। মাঝখানে ভীষণ রকম নিরাপত্তাহীন হয়ে গেছি। সামাজিকভাবে হেয় হওয়াতে পরিচয় গোপন করে চলতে হয়। বাসা ভাড়া পাওয়া যায় না। আর্থিক অনটন তো আছেই। অভাবের তাড়নায় নোয়াখালীর সেনবাগের বসতবাড়িটা বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এখন ঢাকায় এ বাসা-ও বাসায় ভাড়া থাকতে হয়।
২১ আগস্ট হামলা মামলায় আসামি হওয়ার দুঃসহ স্মৃতিচারণ করে জজ মিয়া বলেন, যে ঘটনায় এত মানুষের জীবন গেছে, এত মানুষ আহত হয়েছেন, সেই ঘটনার মূল আসামি ছিলাম আমি। মনে হলেই কেমন যেন লাগে। সিআইডি অফিসের কথা মনে হয়ে যায়। আবার মনে করি, যারা আমাকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়েছিল, তারাই তো এখন আসামি। দুনিয়াতেই তো বিচার পেয়ে গেছি।
জজ মিয়ার ইচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের। তাকে তিনি নিজ কষ্টের কথা বলতে চান। জানাতে চান দরিদ্র ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কীভাবে তাকে ২১ আগস্ট মামলার আসামি বানানো হয়েছিল। কতটা অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে তাকে ভুয়া জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়। বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্রে তার সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় জীবন থেকে বহু কিছু হারিয়ে গেছে।
প্রসঙ্গত, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ১০ মাস পর ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বীরকোট গ্রামের বাড়ি থেকে জজ মিয়া নামের এক যুবককে আটক করে সিআইডি। ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে তার কাছ থেকে এই মর্মে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আদায় করা হয় যে, তিনিই হামলা করেছেন। যদিও একই জবানবন্দিতে তিনি বলেন, গ্রেনেড তিনি কখনো দেখেননি। বোমা ও গ্রেনেডের পার্থক্যও বোঝেন না। ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে বড়ভাইয়ের নির্দেশে তিনি গ্রেনেড হামলায় অংশ নেন। ‘বড়ভাই’ বলতে তিনি সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল প্রমুখের নাম উল্লেখ করেন। পরে জজ মিয়ার মা জবানবন্দিতে বলে দেন, জজ মিয়ার এ জবানবন্দির বিনিময়ে সিআইডি তাদেরকে প্রতি মাসে ভরণপোষণের টাকা দেয়। ২০০৯ সালে সিআইডির অধিকতর তদন্তে উদ্ঘাটিত হয় জজ মিয়ার সেই ভুয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির তথ্য।