করোনা মহামারীতে প্রায় দেড় বছর ধরে আক্রান্ত সারা বিশ্ব। স্থবির হয়ে আছে সব কার্যক্রম। কোনো কোনো দেশ প্রথম ঢেউ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কোনো কোনো দেশ দ্বিতীয় আবার কোনো কোনো দেশ করোনার তৃতীয় ঢেউ সামাল দিতে ব্যস্ত। আমাদের দেশে চলছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুর্বারগতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে দেশের এক কোটি মানুষ করোনার টিকা নিয়েছে। বাকিদের টিকার আওতায় আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। ফাইজারের ১ লাখ ৬ হাজার ডোজ টিকা আসছে আগামী ২ জুন। প্রথম ঢেউয়ের পর দ্বিতীয় ঢেউও দমিয়ে রাখতে পারেনি দেশের অগ্রযাত্রা। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রপ্তানি আয়, আমদানিসহ অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো এখনো ইতিবাচক। মূল্যস্ফীতি আছে সহনীয় পর্যায়ে। গত বেশ কিছুদিন ধরে পুঁজিবাজারেও চাঙা ভাব।
স্বল্পোন্নত দেশের গণ্ডি পেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দেশ। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির তিনটি সূচকেই পাসের চেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণকে বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন আখ্যায়িত করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলেছে- দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও ভিয়েতনামের উন্নয়নের সঙ্গে মিল রয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সফল অর্থনীতির দেশ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেল। মাথাপিছু আয়ে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানকে ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মেটাতে বন্ধুপ্রতীম দেশ শ্রীলঙ্কা আমাদের শরণাপন্ন হয়েছে। দেশটিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ২০ কোটি ডলার ধার দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব খবরে ওই তিন দেশের গণমাধ্যম বাংলাদেশের প্রশংসার পাশাপাশি নিজ নিজ দেশের সরকারের তীব্র সমালোচনা করছে।
অর্থনৈতিক সূচকের পাশাপাশি সামাজিক সূচকেও বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও এগিয়ে আছে। দারিদ্র্যবিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এখন আলোচিত। অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন সুযোগ পেলেই বাংলাদেশের এই সাফল্যের কথা দেশি-বিদেশি মানুষকে শোনান।
পাকিস্তানের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক উপদেষ্টা আবিদ হাসান বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করে দিয়েছেন চমকপ্রদ তথ্য। তার মতে, পাকিস্তানের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা বজায় থাকলে আগামী এক দশকের মধ্যে দেশটিকে বাংলাদেশের কাছে হাত পাততে হতে পারে। গত সোমবার পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনালে প্রকাশিত এইড ফ্রম বাংলাদেশ নামের ওই নিবন্ধে তিনি বলেন, ২০ বছর আগেও চিন্তা করা যেত না যে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের দ্বিগুণ হবে। বাংলাদেশের অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে এটি ২০৩০ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হবে। পাকিস্তানের এখনকার পরিস্থিতির পরিবর্তন না ঘটলে এক দশকের মধ্যেই হয়তো বাংলাদেশের কাছে আমাদের সাহায্য চাইতে হবে।
বাংলাদেশের সফল অগ্রযাত্রাকে ভালো উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে আবিদ বলেন, গত দুই দশকে প্রধান অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে পাকিস্তানকে ছাড়িয়েছে বাংলাদেশ। ২০ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি বেড়েছে ৫০০ শতাংশ-যা পাকিস্তানের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি। ২০০০ সালে পাকিস্তানের রপ্তানির পরিমাণ বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ বেশি ছিল। এরপর থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে ৭০০ শতাংশ-যা পাকিস্তানের বৃদ্ধির চেয়ে প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেশি। ২০২০ সালে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ পাকিস্তানের প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
করোনা মহামারীর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) বাড়া অব্যাহত ছিল। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ধারাবাহিক অগ্রগতির পথ ধরে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বাংলাদেশ-যা ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি। গত এক দশকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। আর চার বছরে এই হার ছিল ৭ শতাংশের উপরে। তবে করোনার ধাক্কায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্জিত হবে বলে প্রাথমিক হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। মহামারীর কারণে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে। কোনো কোনো দেশে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ।
জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মাথাপিছু আয়। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ২২৭ ডলার। ভারতের ১ হাজার ৯৪৭ ডলার ও পাকিস্তানের ১ হাজার ২৬০ ডলার। শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ৬৮২ ডলার। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৭৫৯ ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এক যুগে মাথাপিছু আয় প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। মাথাপিছু আয়ে ভারতকে বাংলাদেশের ছাড়িয়ে যাওয়া নিয়ে গত কয়েক দিনে ভারতের গণমাধ্যম মোদি সরকারের তীব্র সমালোচনা করছে, প্রশংসা করেছে বাংলাদেশের।
গত রোববার দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ২২৭ ডলার। বর্তমান বাজারদরে বাংলাদেশি মুদ্রায় এই অঙ্ক ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৫০ টাকা। আর প্রতিবেশী দেশ ভারতের মানুষের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৯৪৭ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যা ১ লাখ ৬৫ হাজার ১০৫ টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের মাথাপিছু আয় ২৮০ ডলার কম। অর্থাৎ ভারতের একজন নাগরিকের চেয়ে বাংলাদেশের একজন নাগরিক এখন বছরে ২৩ হাজার ৭৪৪ টাকা বেশি আয় করেন। মহামারী মোকাবিলায় নেওয়া লকডাউন ভারতের অর্থনৈতিক সংকোচনের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক মূল্যস্ফীতি বেশ কিছুদিন ধরে সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। এখন (এপ্রিল) তা কমে ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশে নেমে এসেছে।
অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বা প্রবাস আয়। প্রতিবছরই বাড়ছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক। মহামারীর মধ্যেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন অব্যাহত রয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিলে ২০৬ কোটি ৭০ লাখ (২ দশমিক ০৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এটি গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে ৮৯ দশমিক ১১ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহে এত বেশি প্রবৃদ্ধি আগে কখনো হয়নি। সব মিলিয়ে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ২ হাজার ৬৭ কোটি ২০ লাখ (২০.৬৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের পুরো সময়ের (জুলাই-জুন) চেয়েও ১২ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি। আর গত অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ের চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি।
চলতি ১-২০ মে ১৫৮ কোটি ৮৮ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে দেশে, যা গত বছরের পুরো মে মাসের চেয়েও ৮ কোটি ৪২ লাখ ডলার বেশি। সব মিলিয়ে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের ১০ মাস ২০ দিনে (২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ২০ মে) ২ হাজার ২২৫ কোটি ৪৬ লাখ (২২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন) রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে এক বছর বা অর্থবছরে এত বেশি রেমিট্যান্স পাঠাননি প্রবাসীরা। অর্থবছর শেষ হতে আরো ১ মাসের বেশি বাকি।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের আশা, অর্থবছর শেষে এবার রেমিট্যান্সের অঙ্ক ২৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ হাজার ৮২০ কোটি ৫০ লাখ (১৮.২০ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। ১২ বছর আগে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এ সময়ে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় তিন গুণ।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে মহামারীর মধ্যেই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন (৪ হাজার ৫০০ কোটি) ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। ৩ মে রিজার্ভ এই নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়। ২০০৮-০৯ অর্থবছর শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ১২ বছরে রিজার্ভ বেড়েছে ছয় গুণ।
অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোর মতো আমদানিও বেড়েছে সমানতালে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে পণ্য আমদানিতে মোট ব্যয় হয়েছিল ২২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সেই ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ব্যয় হয়েছে ৪২ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ শতাংশের বেশি।
২০০৮-০৯ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ১৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সেই আয় আড়াই গুণের বেশি বেড়ে ৪০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। কিন্তু করোনার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা কমে ৩৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে যায়। তবে মহামারীর মধ্যেও চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৩ হাজার ২০৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।
প্রতি বছর বাজেটের আকার যেমন বেড়েছে, রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও তেমনি বেড়েছে। এমনকি মহামারীর এই কঠিন সময়েও রাজস্ব আদায়ের ইতিবাচক ধারা ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৬৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছিল। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা বেড়ে ২ লাখ ১৮ হাজার ৪০৬ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। চলতি অর্থবছরের নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) আদায় হয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি।
কৃষিতেও সাফল্য ঈর্ষণীয়। মহামারীতে বিভিন্ন খাত সমস্যায় পড়লেও কৃষি খাতের তেমন ক্ষতি হয়নি। মহামারীকালে দুই ফসল মৌসুমেই কৃষকেরা ধানের ভালো দাম পেয়েছে। গত মৌসুমেও ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা ধানের মণ দাম পেয়েছে কৃষকেরা। এটি ধান উৎপাদনে কৃষকের আগ্রহ ধরে রাখায় ভূমিকা রাখবে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতির মধ্যেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টায় বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে। মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান এখন ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশে কৃষির বাণিজ্যিক রূপান্তর শুরু হয়েছে। খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান দশম।
উন্নয়নের সব সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান উর্ধমুখী হলেও বিনিয়োগে স্থবিরতা এখনো রয়েই গেছে। ইতিবাচক খবরে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে মহামারী মোকাবিলার পাশাপাশি বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, যে কারণেই হোক না কেন-এখন পর্যন্ত কোভিড বাংলাদেশকে খুব বেশি কাবু করতে পারেনি। মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা এখনও সহনীয়ই আছে। তবে আগামীতে কী হবে সেটা বলা মুশকিল। যে করেই হোক, সেখান থেকেই হোক, যতো টাকাই লাগুক, সবাইকে দ্রুততর সময়ের মধ্যে টিকা দিতে হবে। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, ভারতের মতো অবস্থা হলে কিন্তু আমরা সামাল দিতে পারব না। সব দিক দিয়ে শেষ হয়ে যাব। তাই সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়ে রাখতে হবে।
তিনি বলেন, গত এক যুগে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি করেছে। তবে এতে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না। ব্যাংকিং খাত ও রাজস্ব প্রশাসনে ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। আমাদের ব্যাংকিং খাত কিন্তু ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। ব্যাংকগুলো যে বিপুল অঙ্কের প্রণোদনার ঋণ দিচ্ছে, সেগুলো যদি ঠিকমতো আদায় না হয়, তাহলে আরো সংকটে পড়বে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে; ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত কমপক্ষে ১৪-১৫তে নিয়ে যেতে হবে। যে করেই হোক বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে। মুদ্রা বিনিময়ের (কারেন্সি সোয়াপ) আওতায় শ্রীলঙ্কাকে ২০ কোটি ডলার ঋণ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এভাবে ডলার দিচ্ছে। এতে বাংলাদেশের সুনাম হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়বে।
আরেক অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন বলেন, সংকটের সময় নতুন নতুন সম্ভাবনা দেখা দেয়। আমরা যদি সেগুলো ভালোভাবে বিচার-বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেই, তাহলে সেসব সম্ভাবনার সুফল পাব। মহমারীর এ সময় যদি আমরা বিশ্ব পরিস্থিতি মাথায় রেখে সুনির্দিষ্ট খাত চিহ্নিত করে বিনিয়োগ করি, সহায়তা দেই তাহলে দেশীয় বাজারের পাশাপাশি বিশ্ববাজারও ধরতে পারব। এখন কঠিন সময়। কোভিডের মধ্যে চার-পাঁচ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও যথেষ্ট। আগামী অর্থবছরগুলোতে যাতে প্রবৃদ্ধি বেশি হয়, সেদিকেই বেশি নজর দিতে হবে।
ব্যবসায়ী নেতা ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, এখন ছোট ও মাঝারি শিল্পের দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। সরকার প্রথম দফায় যে সোয়া লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল, তার বেশিরভাগ বড় উদ্যোক্তারা পেয়েছে। করোনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছোট-মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তারা কিন্তু বঞ্চিত হয়েছে। এখন নতুন করে তাদের সহায়তা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ছোট-মাঝারি শিল্পগুলো ঘুরে না দাঁড়ালে বড় বড় শিল্পগুলোও কিন্তু ধাক্কা সামলে উঠতে পারবে না। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থতির কারণে চায়না ও ভিয়েতনামের তৈরি পোশাকের অর্ডার এখন বাংলাদেশে আসছে। সে সুযোগগুলো ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে আমাদের রপ্তানি আয় আরো বাড়বে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ছিল পাঁচের ঘরে। ১০ বছরে সেই প্রবৃদ্ধি বেড়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে উঠেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে, গত ১২ বছরে দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির আনুপাতিক হারে বেড়েছে সামান্যই। সেই ৩১/৩২ শতাংশেই আটকে আছে বিনিয়োগ।
করোনার ধাক্কায় গত এক বছরে অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ৯ শতাংশের নিচে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের ৯ মাসে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে ৪২ শতাংশ, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে কম। গত কয়েক মাস ধরে আমদানি বাড়লেও কল-কারখানা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি খুব একটা বাড়েনি।