বিভিন্ন সংকটে চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে রাজধানীবাসী। ঘর থেকে বের হলে যানজট, বায়ু আর শব্দদূষণে বিপর্যস্ত হতে হয়। আর ঘরে ফিরলে পানি বা গ্যাস সংকটে নাকাল হতে হয়। শুধু তাই নয়, মশার যন্ত্রণায় সারারাত নির্ঘুম কাটাতে হয় মধ্য ও নিম্নবিত্তের লাখো মানুষকে। সেই সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর লাগামহীন বাড়িভাড়ার চাপ বাড়ছে।
বর্তমানে উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে ঢাকার যানজট পরিস্থিতি। ট্র্যাফিক জ্যামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকাটাই যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এই যানজটের কারণ কী তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছেতো চলছেই। এর মধ্যে যানজট নিরসনে নেওয়া হয়েছে নানা পরিকল্পনা, এমনকি মহাপরিকল্পনাও। কিন্তু কোনো পরিকল্পনাই ফলপ্রসূ হচ্ছে না। এসব অপরিকল্পিত পরিকল্পনার কারণেই ঢাকার যে সড়ক আজ ‘ওয়ান ওয়ে’, কালই তা হয়ে যাচ্ছে ‘টু ওয়ে’। আজ এই সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ তো কাল আবার খুলে দেওয়া হচ্ছে। কোনো রাস্তায় আবার চলছে আইল্যান্ড বা সড়ক দ্বীপ তৈরি এবং ভাঙার খেলা।
সম্প্রতি যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জাতীয় সংসদে জানান, একটি আধুনিক নগরীতে মোট আয়তনের ২০ থেকে ২৫ ভাগ রাস্তা বা সড়ক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকায় আছে মাত্র সাত থেকে আটভাগ। প্রয়োজনের মাত্র এক তৃতীয়াংশ সড়ক আছে এই শহরে। ঢাকা শহরের মোট এলাকা ১৩৫৩ বর্গ কিলোমিটার, আর বর্তমান রাস্তার আয়তন ২,২০০ কিলোমিটার, যার মধ্যে ২১০ কিলোমিটার প্রধান সড়ক। অন্যদিকে ট্র্যাফিক বিভাগের হিসাব মতে, সেই সড়কের কম করে হলেও ৩০ ভাগ বা তারও বেশি দখল হয়ে আছে অবৈধ পার্কিং এবং নানা ধরনের দখলদারদের হাতে। এছাড়া ফুটপাথ হকারদের দখলে থাকায় প্রধান সড়কেই পায়ে হেঁটে চলেন নগরবাসী ফলে যানজটের সঙ্গে আছে জনজট। কোন পন্থায় এই শহর যানজটমুক্ত হবে এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনাও নেই।
শুধু যানজটই নয়, ঘনবসতিপূর্ণ এই ঢাকা শহর আজ বিশ্বের শীর্ষ বায়ু ও শব্দ দূষণকারী শহরগুলোর অন্যতম। গত কয়েক বছর ধরেই বায়ুদূষণে বিশ্বের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে চলে আসছে ঢাকার নাম। বায়ু দূষণের ফলে নগরবাসীদের ভুগতে হচ্ছে নানা শারীরিক সমস্যায়। ঢাকার বায়ুদূষণে ধুলার অবদান প্রায় ৭৭ শতাংশ বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে। সম্প্রতি এরকম এক গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়টির রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম। তিনি বলেন, বর্তমানে বায়ুদূষণে ধুলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গাড়ি ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া। বর্তমানে বাতাসে ধুলা আগের চেয়ে পরিমাণে বেড়েছে।
তিনি আরো বলেন, আগে এত মেগা প্রজেক্ট ও গাড়ি ছিল না। পাশাপাশি ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জলাশয় ভরাট হওয়ায় ধুলার নতুন উৎস জন্মেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রীষ্ম মণ্ডলীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ধুলা এমনিতেই বেশি। এরপর কয়েক বছর ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে উন্মুক্ত পরিবেশে নতুন নতুন নির্মাণযজ্ঞ বাড়িয়েছে ধুলাদূষণ। মেট্রোরেলের মতো বড় প্রকল্প, পূর্বাচল সিটি ও বছিলার মতো কিছু অঞ্চল এবং অজস্র ছোট আবাসন প্রকল্প এর মধ্যে রয়েছে।
সম্প্রতি শব্দদূষণেও বিশ্বের শীর্ষ স্থান দখল করে ঢাকা। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপির প্রকাশ করা এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে আসে। শব্দদূষণে ঢাকার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুরাদাবাদ ও পাকিস্তানের ইসলামাবাদ। শব্দদূষণে বাংলাদেশেরই আরেক শহর রাজশাহী রয়েছে চতুর্থ স্থানে। আর পঞ্চম অবস্থানে ভিয়েতনমের হো চি মিন শহর। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গাইডলাইন বা নির্দেশনা অনুযায়ী মানুষের জন্য ঘরের ভেতর শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। আর ঘরের বাইরে বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবেল। অথচ ঢাকায় এই মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল ও রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল।
এদিকে গরমের শুরুতেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র পানি সংকট। কর্তৃপক্ষের কাছে বার বার ধর্ণা দিয়ে সমাধান না পাওয়ায় মিরপুর এলাকাবাসী ওয়াসা অফিস এবং উত্তরার আশকোনা এলাকাবাসী রাস্তা অবরোধ করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুরাদ হোসেন বলেন, বেশকিছু দিন ধরেই এলাকার মানুষ ওয়াসার পানি সংকটে ভুগছে। খুবই খারাপ অবস্থা। আগে সংকট হলে কাউন্সিলর হিসেবে আমাকে বিনামূল্যে পানি দিতো। কিন্তু এখন আমাকেও পানি দিচ্ছে না। আমাকেও ওয়াসার গাড়ির পানি কিনে খেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এলাকার পানি সংকটের বিষয়টি জানিয়ে আমি ওয়াসা অফিসে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। তারপরও এখনো পানি সংকট দূর হয়নি। ওয়াসার কর্মকর্তাদের ফোন দিলেও তারা ধরছে না। একই ধরনের মন্তব্য করেন ডিএনসিসির ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাসেম মোল্লা। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে গরমকালে অত্র এলাকায় পানির সংকট দেখা দেয়। চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় এলাকাবাসীদের। ওয়াসার কাছে বারবার ধর্না দিয়েও প্রতিকার পাওয়া যায় না।
এ বিষয়ে ওয়াসার স্থানীয় মডস জোনের-৪ নির্বাহী প্রকৌশলী ইকবাল আহমেদ মজুমদার বলেন, গরম বেড়ে যাওয়ায় পানির চাহিদা বেড়েছে। এছাড়া মিরপুর এলাকায় পাম্পের পানি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু গরমের সময় পানির স্তরও ২/৩ মিটার নিচে নেমে যাওয়ায় পানির উৎপাদন কমে গেছে। এ কারণে কয়েকটি এলাকায় পানি সংকট দেখা দিয়েছে। তবে আমরা বিষয়টি সমাধান করার চেষ্টা করছি।
জানা যায়, সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার থেকে যেসব এলাকায় পানি সরবরাহ করা হচ্ছে সে সব এলাকায় পানি সংকটের পাশাপাশি দুর্গন্ধও বেড়ে গেছে। এতে ওইসব এলাকার বাসিন্দারা বেশ সংকটে পড়েছেন। যাত্রাবাড়ি, মুগদা, মানিকনগর, বাসাবো এলাকার বাসিন্দারা গত কয়েকদিন ধরেই পানি সংকট ও দুর্গন্ধ জনিত সমস্যায় ভুগছেন।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানি সংকটের বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার পরিচালক (কারিগরি) একেএম সহিদ উদ্দিন বলেন, গরমের সময় পানির স্তর দুই-তিন মিটার করে নিচে নেমে যায়। এ কারণে যে পাম্পে দৈনিক আড়াই হাজার লিটার পানি উৎপাদন হতো সেখানে এখন ১৮শ লিটার পানি উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়া গত কয়েকদিন ধরে গরম বেড়েছে। এতে মানুষ বেশি পানি ব্যবহার করছে। অনেকে দিনে দুই তিনবারও গোসল করছেন। এ কারণে লাইনের শুরুর দিকের বাড়িগুলোতে পানি থাকলেও একটু দূরে যারা আছেন তাদের কাছে পানি ঠিকমত পৌঁছাচ্ছে না। এতে ওইসব বাড়িগুলোতে পানি সংকট হচ্ছে। তবে সংকটের খবর পেলে ওয়াসার পক্ষ থেকে দ্রুত বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
রাজধানী বিভিন্ন এলাকাতে দীর্ঘদিন ধরে চলছে গ্যাস সংকট। আর রমজানের শুরুতে বেশ কিছু এলাকায় এই সংকট চরম আকার ধারণু করেছে। রাজধানীর অনেক এলাকায় দিনভর চুলাই জ্বলছেনা। গ্রিনরোড, ইস্কাটন, বাংলামোটর, ৬০ ফিট, রামপুরা, ধানমন্ডি, মিরপুর, উত্তরা, ওয়ারিসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে এই সংকট। আগামী এক সপ্তাহ এই অবস্থা চলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গ্যাস সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, শেভরন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে জরুরি রক্ষণাবেক্ষণের কাজের জন্য এমনটা ঘটেছে। দেশের বড় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মধ্যে একটি বিবিয়ানা। সেই ক্ষেত্রের ছয়টি কূপ বন্ধ রয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে রাজধানীতে। সংকট কাটতে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় লাগবে বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা।
তবে বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডে জরুরি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গ্যাসের বিপর্যয় ঘটলেও রাজদানীর অনেক এলাকাতে সারা বছর ধরেই চলে গ্যাস সংকট। বিশেষ করে শীতকালে এই সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর, মগবাজার, যাত্রাবাড়ী ও পুরান ঢাকার বেশ কিছু এলাকায় গ্যাসের তীব্র সংকট থাকে বছর জুড়েই। ওইসব এলাকার অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নিয়মিত গ্যাস বিল পরিশোধ করেও প্রয়োজনের সময় গ্যাস পান না তারা। তিতাস গ্যাস সংশ্লিষ্টদের মতে, রাজধানীতে গ্যাসের চাহিদা ও ব্যবহার শতকরা ২০ ভাগ বেড়েছে। গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী গরমকালেই অনেক সময় গ্যাসের সরবরাহ ব্যাহত হয়, আর শীতে চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় সংকটের মাত্র ছাড়িয়ে যায়।
এদিকে রাজধানীর প্রায় প্রতিটি সড়ক থেকে ঘর, স্টেশন থেকে গণপরিবহন সর্বত্রই এখন মশার উপদ্রব। মশার গুনগুন শব্দের সঙ্গে হুল ফোটানো নিত্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় সতর্ক করা হয়, মার্চ মাসে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে মশার ঘনত্ব আরো চার গুণ বাড়বে। ওই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, বছরের এ সময়ে মশার জীবনচক্রের গতিশীলতা বেড়ে যায়। এ সময়ে মশা ডিম বেশি পাড়ে। গত বছরের জুন-জুলাইয়ের তুলনায় এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে এসে মশার ঘনত্ব প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) কিউলেক্স মশার মোট ৯২৫টি হটস্পট শনাক্ত করা হয়। এসবের মধ্যে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সাতারকুল। এরপর রয়েছে মিরপুর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে প্রতি ওয়ার্ডে ১৪ জন করে ৭৫টি ওয়ার্ডে মোট ১ হাজার ৫০ জন কর্মী লার্ভিসাইডিং, এডাল্টিসাইডিং এবং সমন্বয় কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। মশক নিধনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আমাদের কাজ চলমান রেখেছি। তবে এই সময়ে এসে মশার উপদ্রব বৃদ্ধি পায়। তাই আমরাও আমাদের কার্যক্রম আরো গতিশীল করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।