স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও দেশের জনস্বাস্থ্য বলে কিছু নেই। স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে চলছে ব্যবসা। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বিদেশ ভ্রমণে যান, আর গরিব মানুষ ঘর বাড়ি বিক্রয় করে চিকিৎসা করছে। এমনকি স্বজনদের চিকিৎসায় নিজের কিডনিও বিক্রি করে দিচ্ছে। শুধুমাত্র ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, স্ট্রোক ক্যানসারের মতো রোগের চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর দেশে ৬৪ লাখ মানুষ নিঃস্ব হয়। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে আলোচকরা এসব কথা বলেন। ‘বাংলাদেশের বর্তমান জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি ও করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে আয়োজন করে ডক্টরস প্ল্যাটফরম ফর পিপলস হেলথ। সেমিনারের সভাপতিত্ব করেন, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী।
আলোচকরা বলেন, স্বাস্থ্য জনগণের অধিকার। অথচ তা এখনো সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসাবে আইন দ্বারা গ্যারান্টেড নয়। বাংলাদেশ আজ মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন। আমরা একটি অসম পৃথিবীতে বসবাস করছি। কিছু মানুষ সুস্বাস্থ্য ও উন্নত জীবনযাপন করছে। অন্যদিকে অধিকাংশ মানুষ কোনো রকমে বেঁচে থাকতে নিরন্তর যুদ্ধ করছে। নিরাপদ পানি সংকট, অনিরাপদ খাদ্য, পানি দূষণ ইত্যাদি মানুষের জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের খরচ মেটাতে মানুষ নিজের সর্বস্ব হারাচ্ছে। দেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধ, দীর্ঘায়িত জীবন এবং স্বাস্থ্য এই তিনটিই জনস্বাস্থ্যর মৌলিক উপাদান, যা রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এগুলোর কোনটির ন্যূনতম টুকুও নিশ্চিত হয়নি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আইন প্রণয়ন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ, দীর্ঘায়িত জীবন ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে বলে জানান তারা।
আলোচকরা আরো বলেন, সর্বোচ্চ মুনাফালাভের জন্য দেশের পুঁজিপতিরা স্বাস্থ্যখাতে পুঁজি বিনিয়োগ করছে। সরকারি ব্যবস্থাপনা ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। প্রকৃতি ও পরিবেশ উজাড় করে চলছে মুনাফা বৃদ্ধি। ফলে এই স্বাস্থ্য সংকটের মূল কারণ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ না করে দেশের মানুষের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যাবে না। একইসঙ্গে এদেশের মানুষ যেহেতু জনস্বাস্থ্য সমস্যার গুরুত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন নয়, তাই মানুষের জন্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি প্রয়োজন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, উন্নয়ন সেটাই যখন সকলের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার পূরণ হবে। যে ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে এতে পানি, বায়ুদূষণ, নিরাপদ খাদ্যের সংকটের কারণ। এসব উন্নয়ন কোনোটাই জনস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী না। উন্নয়নের নামে তারা দেশকে দূষিত করে দিয়েছে। তবে এতে তাদের কিছু আসে যায় না। কারণ তারা বা তাদের পরিবার কেউ এ দেশে থাকে না। এ দেশটা শুধুমাত্র তাদের আয় উপার্জনের ক্ষেত্র। তাদের স্বজনরা এসবের কোনো ফল ভুগছে না। ভুগছে এদেশের সাধারণ মানুষ। আমাদের কৃষকরা সর্বাধিক ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর কারণ কৃষি উপাদানগুলো ক্যানসারের উপাদানে পরিপূর্ণ। যারা কাজ করছে তারা অসুস্থ হচ্ছে, আমরা যারা খাচ্ছি তারাও রোগে আক্রান্ত হচ্ছি।
স্বাস্থ্যসেবার বেসরকারিকরণ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সর্বজন স্বাস্থ্যসেবা সিস্টেম চালু করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা বেসরকারিকরণ বন্ধ করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবসার বিষয় নয়। এটি একটি মৌলিক অধিকার যা সংবিধান অনুযায়ী সরকার নিশ্চিত করার কথা। জনগণ কতটা পাচ্ছে তা নিয়ে জবাবদিহিতা প্রয়োজন। কমিউনিটি ক্লিনিক শুধু কাগজ কলমেই আছে, বাস্তবে নাই। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের খরচ মেটাতে নিজের সর্বস্ব হারাচ্ছে। ঘরবাড়ি বিক্রয় করে চিকিৎসা করছে। এমনকি স্বজনদের চিকিৎসায় নিজের কিডনিও বিক্রি করে দিচ্ছে। এ সময় স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং চিকিৎসক নার্সদের আলাদা বেতন কাঠামো গঠন করে তাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর আহ্বান জানান অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক সাইফুল হক বলেন, দেশে কোনো খাতে জবাবদিহির সুযোগ নেই। সারা দেশে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালে ভরে গেছে। কিন্তু কোনোটাই সেবা দেওয়ার জন্য না, সবই ব্যবসার উদ্দেশ্যে স্থাপন করা হয়েছে। এসবে সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি স্বাস্থ্যের পরিবেশের সাথে মাননসই হয়েছেন, পরিবেশ কতটা বুঝেন, স্বাস্থ্য কতটা বুঝেন সেটা নিয়ে মন্তব্য করবো না। কিন্তু যে মানুষ যে সেক্টরের জন্য প্রশিক্ষিত তাকে সেখানেই দেওয়া উচিত।
স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কর্তা ব্যক্তিদের বিদেশ ভ্রমণের সমালোচনা করে তিনি বলেন, যেখানে সাধারণ মানুষ দেশে ক্যানসারের চিকিৎসা গ্রহণ করে। সেখানে স্বাধীনতার ৫১ বছরের পরেও কেন স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য দেশে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীকে বিদেশে যেতে হবে। তারা যে চিকিৎসা পাবে দেশের কৃষক শ্রমিকেরও একই সেবা পাওয়ার অধিকার আছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, আমরা স্বাস্থ্য খাতে কিছু পাইনি তা নয়। সামপ্রতিক সময়ে আমরা হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংখ্যা বাড়িয়েছি। করোনাকালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে আমরা ১৩টি প্রশংসাপত্র পেয়েছি। আমার স্বাস্থ্য আমার অধিকার, সেটা নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র।
‘স্বাস্থ্য খাতের লোকদের একটা বড় অংশ স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপারে ধারণা রাখেন না। কৃতপেশাভিত্তিক প্রশাসন প্রয়োজন। এতে রাষ্ট্র ও জনগণ অধিক উপকারী হবে। এই বিষয়টি আমাদের দ্রুত বিবেচনায় আনতে হবে,’ যোগ করেন বিএমএ মহাসচিব।
প্রসঙ্গত প্রগতিশীল চিকিৎসকদের কয়েকটি সংগঠন একত্রিত হয়ে করোনাকালে ২০২০ সালের ২২ মে প্রতিষ্ঠা করেছে ‘ডক্টরস প্ল্যাটফরম ফর পিপলস হেলথ’। ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড অ্যানভায়রনমেন্ট, জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদ, প্রগতিশীল চিকিৎসক পরিষদ, স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন, হেলথ সার্ভিস ফোরাম, জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির যৌথ সভায় ‘ডক্টরস প্ল্যাটফরম ফর পিপলস হেলথ’ নামের মঞ্চ গঠিত হয়। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুবকে আহ্বায়ক, অধ্যাপক ডা. মো. আবু সাঈদ ও ডা. ফয়জুল হাকিম লালাকে যুগ্ম-আহ্বায়ক এবং অধ্যাপক ডা. শাকিল আখতারকে সদস্য সচিব করে ১৫ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়।
ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আলোচনা করে এ সংগঠনের জন্ম হয়ে ছিল। সংগঠনটির সূচনালগ্নের প্রথম আলোচনায়ই (২২ মে ২০২০) কোভিড-১৯ সংক্রমণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে চিকিৎসা তথা স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সরকারের স্বাস্থ্যনীতি ও পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করা, অব্যবস্থাপনা, অবহেলা, দুর্বৃত্তায়ন ও বেসরকারি করণজনিতসহ নানা সংকট ফুটে ওঠে।