বঙ্গোপসাগর তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ শক্তি বাড়িয়ে শক্তিশালী রূপ ধারণ করেছে। ঘূর্ণিঝড়টি আজ দুপুর নাগাদ উত্তর উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গ উপকূল অতিক্রম করতে পারে। উপকূলে আঘাত হানার সময় গতিবেগ ঘণ্টায় ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার, যা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৮৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। এসময় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টি হতে পারে। একইসঙ্গে পূর্ণিমার কারণে জোয়ারের পানির উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৪ ফুট বেশি হতে পারে।
এদিকে ইয়াসের প্রভাবে গতকাল দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গেছে বাঁধ, ডুবে গেছে ফসলী জমি। এমনকি দমকা হাওয়ায় ভেঙে পড়ছে গাছপালা। দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে বিপদ সংকেত। এরইমধ্যে গতকাল বুধবার সারা দেশে নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান বিআইডব্লিউটিএর উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান।
বাংলাদেশ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিলেও ইয়াসের গতিপথ দেখে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান আশা করছেন, ঝড়টি এই পথে এগোলে বাংলাদেশের ক্ষতির ঝুঁকি কমবে।
তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, ইয়াস যখন ভারতের উপকূল অতিক্রম করবে সে সময় খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর ও চট্টগ্রাম জেলাগুলো এবং তার আশপাশের দ্বীপ ও চরগুলোতে দমকা হাওয়াসহ ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টি হতে পারে। একইসঙ্গে এসব এলাকার নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ২ থেকে ৪ ফুটে বেশি উচ্চতার জোয়ারের শঙ্কা আছে।
আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, ইয়াসের প্রভাব ইতোমধ্যে দেশের প্রায় সব এলাকায় পড়তে শুরু করেছে। এই বৃষ্টি আরো বাড়বে। এটি ভারতের উপকূল অতিক্রম করতে পারে। যদি এরমধ্যে ঝড়টি কোনো বাধা না পায়। বাধা পেলে গতি ঘুরিয়ে কোথায় যাবে তা কেউ বলতে পারে না।
আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও একইসঙ্গে পূর্ণিমা হওয়ায় স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৪ ফুট বেশি উচ্চতার জোয়ার আসতে পারে। ফলে জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা রয়েছে।
আবহাওয়াবিদ এ কে এম রুহুল কুদ্দুস জানান, পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ উত্তর-উত্তর পশ্চিম দিকে অগ্রসর ও আরও ঘনীভূত হয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার পর একই এলাকায় অবস্থান করছে।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার; যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১১৭ কিলোকিমটার পর্যন্ত বাড়ছে। এ কে এম রুহুল কুদ্দুস বলেন, অনুকূল আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি আরো ঘনীভূত হয়ে উত্তর-উত্তরপশ্চিমে অগ্রসর হয়ে বুধবার ভোর নাগাদ উত্তর পশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় পৌঁছাতে পারে।
জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি বুধবার ভোর নাগাদ উত্তর ওড়িষ্যা-পশ্চিমবঙ্গ উপকূলের কাছে পৌঁছাবে। উপকূল অতিক্রম করতে দুপুর নাগাদ লাগতে পারে। সাগর উত্তাল থাকায় উত্তর বঙ্গোসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পযন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গজুড়ে ব্যাপক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ভারতের আবহাওয়া বিভাগ গতকাল আভাস দেয়, বুধবার প্রথম প্রহরেই ইয়াস শক্তি বাড়িয়ে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে, তখন কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারে উঠতে পারে। আর যখন এটি উপকূলে আঘাত হানবে, তখন এর গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার, যা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৮৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে।
ঘূর্ণিঝড়টি আরো শক্তি বাড়িয়ে ‘অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে’ রূপ নিয়ে বুধবার দুপুর নাগাদ সাগর দ্বীপ ও প্যারাদ্বীপের মধ্য দিয়ে উপকূলে আঘাত হানতে পারে বলে ভারতের আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে। তখন বাতাসের বেগ ঘণ্টায় ১৬৫ কিলোমিটারে উঠতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত জারি : ইয়াসের প্রভাবে ঢাকাসহ সারাদেশে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে, কোথাও কোথাও দমকা হাওয়াও বইছে। দেশের চার সমুদ্রবন্দরকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সতর্ক সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেতের অর্থ ছিল গভীর সাগরে বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার। বন্দর তখনও নিরাপদ, তবে বন্দর ত্যাগকারী জাহাজ পথে বিপদে পড়তে পারে। এখন যে স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেওয়া হয়েছে, তার অর্থ হলো বন্দর ও বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলোর দুর্যোগকবলিত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
নৌযান চলাচল বন্ধ : ইয়াসের কারণে সারা দেশে নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গতকাল বিকাল থেকে তা বন্ধ ঘোষণা হয়েছে বলে বিআইডব্লিউটিএর উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, দুই নম্বর সতর্ক সংকেত রয়েছে। এই সংকেতে ৬৫ ফুটের বড় নৌযান চলাচল করতে পারে। কিন্তু বাড়তি সতর্কতা এবং কোনো ধরনের প্রাণহানি যাতে না ঘটে, সে জন্য এই ঘোষণা। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নদীপথে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে বলে তিনি জানান।
সাতক্ষীরার উপকূলে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি : সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার উপকূলীয় গাবুরা ইউনিয়নের নেবুগুনিয়া এলাকায় কপোতাক্ষ নদীর বাঁধ ছাপিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ শুরু করে। এদিকে, গ্রামবাসীরা মাটি দিয়ে সেগুলো সাময়িক রক্ষা করেছে।
বরগুনায় অর্ধ শতাধিক গ্রাম প্লাবিত : ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার জোয়ারের চাপে বরগুনার নদ-নদীতে বিপৎসীমার ৭৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। এতে জেলার বিভিন্ন স্থানে অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়ায় চরম বিপাকে পড়েন এসব এলাকার হাজারো মানুষ। স্বল্প উচ্চতার ভেড়িবাঁধের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত ও নাজুক বাঁধের কারণে এসব এলাকায় পানি ঢুকে পড়ে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
ভোলায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত : ভোলার চরফ্যাশনে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে কুকরি-মুকরি, ঢালচর ও চরপাতিলাসহ বেশ কয়েকটি নিচু এলাকা। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত দুই হাজার মানুষ।
পটুয়াখালীতে জোয়ারের পানিতে বাঁধ ঝুঁকিতে, নিম্নাঞ্চল প্লাবিত : পটুয়াখালীর নদ-নদীতে জোয়ারের পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত বছর আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংস্কারের পরও জেলায় ৬১ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়ে গেছে। বেশি ঝুঁকিতে আছে ২০ কিলোমিটার বাঁধ।
এদিকে জোয়ারের পানির প্রবল চাপে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ উপচে জোয়ারের পানিতে কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালী উপজেলার অন্তত ১৬টি গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন উপজেলা রাঙ্গাবালীর অরক্ষিত পাঁচটি চরাঞ্চলের প্রায় দেড় হাজার মানুষকে সরিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে আনার প্রস্তুতি নিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
পিরোজপুরে ভেড়িবাঁধে ভাঙন : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় মাঝের চরের তিনটি স্থানের ভেড়িবাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। গত সোমবার সকাল থেকে থেমে থেমে দমকা হাওয়া ও ঝড়ো বৃষ্টি বইতে শুরু করেছে। বলেশ্বর নদী বেষ্টনী এলাকার ৫টি ইউনিয়নের লোকজন নিকটতম আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে শুরু করেছে।
বাগেরহাটে প্রস্তুত ৯৭৩ আশ্রয় কেন্দ্র, বন্ধ পূর্ব সুন্দরবনের ঝঁকিপূর্ণ ৮ বন অফিস : উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটে প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৯৭৩ আশ্রয় কেন্দ্র। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ঘূর্ণিঝড়ের সময় করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রায় ৩ লাখ লোকের থাকাসহ গবাদি পশুও রাখা যাবে। একই সাথে এসব আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা হয়েছে হ্যান্ড সেনিটাইজার, মাস্কসহ পর্যাপ্ত পানি। জেলা সদরসহ জেলার ৯টি উপজেলা পুলিশ, মোংলা বন্দর কর্তপক্ষ, কোস্টাগার্ড, নৌবাহিনী, রেডক্রিসেন্ট, ফায়ার সার্ভিস ও পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ জরুরি সেবা দিতে কন্ট্রোল রুম খুলেছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রায় ৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছেন। ইয়াস আতঙ্কে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্চের ঝুঁকিপূর্ণ ৮টি অফিস বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এসব অফিসে কর্মরত কর্মকর্তা ও বনরক্ষীসহ ৫০ জনকে নিরাপদে আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।