• শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪২৮

বাংলাদেশ

রানা প্লাজা ধসের পাঁচ বছর

কাজের সামর্থ্য হারিয়েছে আহত অর্ধেক শ্রমিক

  • জাহিদুল ইসলাম
  • প্রকাশিত ২৪ এপ্রিল ২০১৮

সাভারের রানা প্লাজা ধসে নিহত হাজারের বেশি শ্রমিক পরিবারে হাহাকার থামছে না। পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মধ্যস্থতায় গঠন করা তহবিল থেকে ক্ষতিপূরণ পেলেও স্থায়ী আয়ের উৎস হারিয়ে পরিবারগুলো চরম বিপাকে। তবে সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে আছেন দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকরা। তাদের অর্ধেকই কাজ করার সামর্থ্য হারিয়েছেন চিরতরে। আবার সামর্থ্য থাকলেও অন্য কোনো কারখানায় কাজ পাননি অনেকে। তাছাড়া দুর্ঘটনা পরবর্তী সংস্কার কার্যক্রমে বেকার হয়েছেন আরো লক্ষাধিক শ্রমিক।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ঘটে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল। ৯ তলাবিশিষ্ট ভবনটি ভেঙে পড়ায় এতে থাকা পাঁচ পোশাক কারখানার ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক প্রাণ হারান। এ ঘটনায় ২ হাজারের বেশি আহত হন। আজ মঙ্গলবার এ দুর্ঘটনার পাঁচ বছর পূরণ হচ্ছে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের বেশকিছু সংগঠন। বাংলাদেশের খবরের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে আহত ও নিহত শ্রমিকদের অসহায়ত্বের বিষয়টিও।

ওল্ড রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের গাইবান্ধা অনাথশ্রমে আশ্রয় হয়েছে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় নিহত পরিবারের ৪০ অনাথ শিশুর। গতকাল সোমবার এ অনাথ আশ্রমে উপস্থিত হয়েছিলেন বেশকিছু পরিবারের সদস্যরা। তাদেরই একজন দুর্ঘটনার ভয়াবহ শিকার রংপুর সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের মহিন্দ্র গ্রামের আনোয়ারা বেগম। তিনি জানান, দুর্ঘটনার পর মাথায় আঘাত পাওয়ায় তিনি কোনো কাজ করতে পারছেন না। পরিবারের অন্য সদস্যদের গলগ্রহ হয়ে তিনি বর্তমানে গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছেন। তিন দফায় তিনি ৯৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেলেও এখন তার খোঁজ আর কেউ রাখছেন না।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের ৪৮.৭ শতাংশ এখন আর শারীরিক বা মানসিকভাবে কর্মক্ষম নয় বলে অ্যাকশন এইডের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। দুর্ঘটনার পর শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও পোশাক খাতের উন্নয়নে সরকার, মালিক ও ক্রেতাদের উদ্যোগগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলেও এতে দাবি করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশ করা এ প্রতিবেদনের সমালোচনা করা হয়েছে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে।

দুর্ঘটনার শিকার জীবিত ২০০ শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে অ্যাকশন এইড। এতে বলা হয়েছে, জীবিত শ্রমিকদের মধ্যে ১২ শতাংশের শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। আর ২২ শতাংশ এখনো মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। গবেষণায় অংশ নেওয়া ৪৮ দশমিক ৭০ শতাংশ শ্রমিক এখনো কোনো কাজ করতে পারছেন না। পোশাক খাতে আবার যোগ দিতে পেরেছেন মাত্র ২১ দশমিক ৬০ শতাংশ শ্রমিক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকরা প্রথমদিকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দ্রুত কিছু টাকা পেয়েছেন। তবে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারছেন না তারা। এ ধরনের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমরা শ্রমিকপ্রতি ১৫ লাখ করে টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তবে আইনে মাত্র ১ লাখ টাকা দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে। যেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর আইনের দোহাই দিয়ে মালিকরা ক্ষতিপূরণ দিতে চান না।

তবে আহত ও নিহত শ্রমিক পরিবারগুলোকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করছে বিজিএমইএ। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, রানা প্লাজার পাঁচ কারখানার শ্রমিকদের বেতন ও পাওনাদি পরিশোধ, আহতদের চিকিৎসা ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন বাবদ প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অভিযুক্ত পাঁচটি কারখানার সদস্যপদ বাতিল এবং এসব কারখানার মালিকদের আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে সহায়তা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ও নিহত শ্রমিক পরিবারকে ২৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সহযোগিতায় গঠিত তহবিল থেকে ২৪০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। দেশের পোশাক খাত নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চলছে বলেও এ সময় জানানো হয়।

তবে দুর্ঘটনার শিকার পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অসঙ্গতি রয়েছে বলে দাবি করছেন শ্রমিক নেতারা। এ বিষয়ে মোশরেফা মিশু বলেন, দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়ে কর্মক্ষমতা হারানো ৩১০ শ্রমিক যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাননি। শিউলি, হালিমা, নিলুফা, রহিমার নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এমন বেশকিছু আহত শ্রমিক নামমাত্র ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। এ অবস্থায় তহবিল থাকলেও ক্ষতিপূরণ নেওয়ার মতো আহত শ্রমিক নেই বলে বিজিএমইএ সভাপতির বক্তব্যকে নির্জলা মিথ্যা বলে দাবি করেন তিনি।

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, হাজারের বেশি ‘শ্রমিক হত্যার’ অভিযোগে সোহেল রানার ফাঁসি চাওয়া হয়েছিল। তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছিল। তাছাড়া এমন দুর্ঘটনা যাতে আর না ঘটে সংশ্লিষ্টদের কাছে সে নিশ্চয়তাও চাওয়া হয়েছিল। গত পাঁচ বছরে এসব দাবি পূরণ হয়নি বলেও তিনি জানান।

এ শ্রমিক নেতা আরো বলেন, দুর্ঘটনার পর শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ের অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের চাপে বন্ধ হয় আরো ২৬৫ কারখানা। এসব কারখানার এক লাখের বেশি শ্রমিক এখন বেকার। বেশকিছু কারখানা স্থানান্তরের সময় শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। এসব ঘটনায় শ্রমিকদের ন্যায্য পারিশ্রমিক দেওয়া হয়নি। এক কথায়, রানা প্লাজা ধসের পর গোটা পোশাক খাতের শ্রমিকদের মধ্যে আর্থিক দুর্দশা নেমে এসেছে বলে তিনি দাবি করেন।

ভালো নেই মানিকগঞ্জের নিহত ৬০ শ্রমিকের পরিবার : রানা প্লাজায় নিহত শ্রমিক কবিতা বেগমের মা রাজেদা বেগমের বাড়িতে যেতেই কেঁদে ফেলেন তিনি। বিলাপ করে বলতে থাকেন, ‘কবিতা হেসকার কালে বাড়ি আইছিল পয়লা বৈশাখ। মাইয়াডা বাজার তন তরমুজ কিনা আনছিল। নিজের আতে কাইটা বাড়ির হগলরে খাইয়াল। যাইবার সময় বলছিল, মা আবার বাড়ি আহনের সময় তোমাগ লিগা গরুর মাংস আনুম। হেই যে গেল কবিতা গরুর মাংস আনব কইয়া, বাড়ি আইল ঠিকই, তয় লাস হইয়া।’

একই গ্রামের সোহেল বড় ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করতেন রানা প্লাজায়। তিনি বলেন, প্রতিদিনের মতো সেদিনও কাজ করতে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ বিকট শব্দ হয়। জ্ঞান ফেরার পর দেখি ধুলা ও অন্ধকার। দেখি আমার মাথার ওপর আধা হাত জায়গা আছে শুধু। হামাগুড়ি দিয়ে একটু আলো দেখতে পাই। আলো ধরে এগুতে থাকি, পরে ওপর থেকে লাফ দিই। পরে ৮তলা থেকে লাফ দিয়েছি। সামান্য ব্যথা পেলেও আমার বড় ভাই জাহাঙ্গীরকে আর খুঁজে পাইনি।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন : হাসান ফয়জী, মানিকগঞ্জ ও হান্নান আকন্দ, গাইবান্ধা প্রতিনিধি

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads