ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডাক্তারদের পর্যবেক্ষণ ছিল- শিশুটি মায়ের গর্ভেই মারা গেছে। সকালে স্বাভাবিকভাবেই ভূমিষ্ঠ হয় সে। ডাক্তাররাও লিখে দেন ডেথ সার্টিফিকেট। মা শারমিন আক্তারের অবস্থাও সঙ্কটাপন্ন। স্বামী মিনহাজ উদ্দিন ছোটাছুটি করছেন তার চিকিৎসা নিয়ে। এদিকে কবর দিতে শিশুটির নিথর দেহ একটি কার্টনে নিয়ে আজিমপুর গোরস্তানে ছুটে যান শিশুটির মামা পুলিশ কনস্টেবল শরিফুল ইসলাম।
কবর খোঁড়া হয়েছে। বাঁশ চাটাই প্রস্তুত। শেষ গোসলের আয়োজনও সম্পন্ন। কিন্তু গায়ে পানি ঢালতেই চিৎকারে শিশুটি জানান দেয়- সে আসলে মরে নাই। গতকাল সোমবার আজিমপুর গোরস্তানে এই ঘটনাটি আবারো দেশবাসীর সামনে নিয়ে এলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তারদের চিকিৎসা অবহেলার বিষয়টি। শিশুটি এখন ঢাকা শিশু হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে আছে। ডাক্তাররা জানিয়েছেন বিভিন্ন কারণে শিশুটির টিকে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে আশার কথা হলো শিশুটির শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
অপরদিকে কবরস্থানে বেঁচে ওঠা শিশুটি যে ঢামেকে ভর্তি শারমিনেরই সন্তান- তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে ঢামেক কর্তৃপক্ষ। তারা প্রয়োজনে ডিএনএ টেস্টেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন। আর এ ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে কমিটির প্রতিবেদন দেওয়ার কথা রয়েছে।
শরিফুল ইসলাম জানান, আমার বোন মৃত বাচ্চা জন্ম দিয়েছে বলে ডাক্তার আমাদের জানান। এরপর ঢাকা মেডিকেল থেকে একটা ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। সকাল ১০টার দিকে মৃত ভাগ্নিকে দাফন করতে আজিমপুর গোরস্তানে যাই। সেখানে শিশুটিকে গোসল ও কাফনের জন্য গোরস্তানকর্মী ইয়াসমিন আক্তার ঝর্ণার হাতে তুলে দিয়ে আমি কবরস্থানের তত্ত্বাবধায়ক হাফিজুল ইসলামের অফিসকক্ষে যাই। সেখানে দাফনের নিবন্ধন খাতায় মৃত ভাগ্নির নাম ঠিকানা লিখছিলাম। দাফনের জন্য একটা নাম দেওয়া দরকার। কোনো কিছু না ভেবেই নাম দিয়েছিলাম মিম। এ সময় ইয়াসমিন দৌড়ে এসে জানায়, ‘আপনাদের শিশুটি বেঁচে আছে।’ শুনে আমিও দৌড়ে গিয়ে দেখি মিম শ্বাস নিচ্ছে ও হাত পা নাড়ছে। এরপর মিমকে নিয়ে ছুটে যাই আজিমপুর মাতৃসদনে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেছি। এখন কী অবস্থায় আছে ডাক্তাররা ভালো বলতে পারবেন।
মিমের বাবা মিনহাজ উদ্দিন জানান, শারমিন ও সে দুজনই গার্মেন্টকর্মী। মিম তাদের প্রথম সন্তান। শারমিন ২৮ সপ্তাহের সন্তানসম্ভবা ছিলেন।
গত ১৯ এপ্রিল রক্তশূন্যতার কারণে শারমিনকে সাভারের একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় পরদিন নিয়ে আসা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক)। ২১ এপ্রিল রাতে ঢামেক চিকিৎসকরা জানান শারমিনের গর্ভের বাচ্চাটি মারা গেছে। এরপর গতকাল সোমবার সকালে শারমিনকে নেওয়া হয় ডেলিভারি করানোর জন্য। সকাল সাড়ে ৮টায় স্বাভাবিক প্রসব হয় শারমিনের। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নবজাতকের শ্বাস-প্রশ্বাস চালু না হওয়া এবং কেঁদে না ওঠায় মিমকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল আজিজ জানান, শিশুটিকে যখন আমাদের কাছে নিয়ে আসা হয়, তখন তার হার্টবিট খুবই কম ছিল। আমাদের জরুরি বিভাগে কৃত্রিমভাবে তার হার্টবিট বাড়ানো হয়। বর্তমানে শিশুটা কার্ডিয়াক আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে আছে।
তিনি বলেন, শিশুটির শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে বিপদ কাটেনি। একটা শিশুর যেখানে কমপক্ষে ৩৩ সপ্তাহ মায়ের গর্ভে থাকার কথা সেখানে শিশুটি ছিল মাত্র ২৮ সপ্তাহ। তাছাড়া তার ওজন মাত্র এক কেজি। স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছিল না। নাভি থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। আমাদের এখানে আনার পর আমরা নাভির রক্তক্ষরণ বন্ধ করি। তবে আশার কথা, এই অবস্থা থেকেও অনেক শিশুর সুস্থ হওয়ার নজিরও শিশু হাসপাতালেই আছে বলে জানান তিনি। শিশু হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে মিম কার্ডিয়াক বিভাগের চিকিৎসক ডা. মঞ্জুর হোসেন ও ডা. মামুনের তত্ত্বাবধানে আছে।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগাযোগ করা হলে, শারমিনের চিকিৎসা ও ডেলিভারির দায়িত্বে থাকা কোনো চিকিৎসক কথা বলতে রাজি হননি। তবে মিম নামে শিশুটি ঢামেকে ভর্তি থাকা শারমিনের সন্তান কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, মৃত ঘোষণা করা শিশুটি কবরস্থানে নড়েচড়ে উঠেছে, এখন শিশু হাসপাতালে ভর্তি আছে এমন খবর আমরা পেয়েছি। তবে শিশুটি আসলেই শারমিনের কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আমরা এ বিষয়ে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। আমাদের উপপরিচালক ডা. বিদ্যুৎ কান্তি লালকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি কমিটি তদন্ত করছে। প্রয়োজনে শিশুটির ডিএনএ টেস্ট করানো হবে।