• শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪২৮

বাংলাদেশ

তিন তরুণ ছাপচিত্রীর প্রদর্শনী ‘উত্তরাধিকার’ 

  • সালেহীন বাবু
  • প্রকাশিত ০২ আগস্ট ২০২১

এদেশে শিল্পকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ প্রচারবিমুখ, প্রচ্ছন্নে থাকা একজন মানুষ। সফিউদ্দীন আহমেদ চল্লিশ দশকের মধ্যপর্যায়ে ভারতবর্ষের চিত্রকলা জগতের উদীয়মান উজ্জ্বল পরিচিত নাম। তেলরং, উড এনগ্রেভিং, এচিং, একুয়াটিন্ট, ড্রাই পয়েন্ট সব মাধ্যমেই তাঁর সাফল্য চোখে পড়ার মতো। তিনি শিল্পকলা রসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন সহজেই। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও নিরলস পরশ্রমের ফসল চারুকলা অনুষদের প্রিন্টমেকিং বিভাগ। যার প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক ছিলেন তিনি। ২৩ জুন শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ এ ৯৯ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সফিউদ্দীন শিল্পালয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের প্রিন্টমেকিং বিভাগের শিল্পগুরু সফিউদ্দীন পদকপ্রাপ্ত তিনজন তরুণ ছাপচিত্রীর বিশেষ ছাপচিত্র প্রদর্শনী ‘উত্তরাধিকার’ শুরু হয়েছে। তিনজন শিল্পী হলেন,  মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম মজুমদার শাকিল, মো. শাহেদ হোসাইন ও আশরাফুল আলম রানা। এ ছাড়াও সফিউদ্দীন আহমেদ প্রিন্টমেকিং স্টুডিওর সদস্যদের দলীয় প্রদর্শনী, যা প্রদর্শিত হচ্ছে স্টুডিওর অভ্যন্তরে।

এবিষয়ে শিল্পী ফখরুল ইসলাম মজুমদার শাকিল বলেন, এবারের প্রদর্শনীর টাইটেল হচ্ছে উত্তরাধিকার। চারুকলায় শিল্পীগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ পুরস্কার দেওয়া হয় প্রতি বছর। আমরা পাঁচজন সেই পুরস্কার পাই। পুরস্কার পাওয়া ৫ জনের মধ্য থেকে ৩ জন এই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছে। এখানে স্টুডিও ও গ্যালারি দুইটা আলাদা পার্ট রয়েছে। আমাদের ছবিগুলোর প্রদর্শন হচ্ছে গ্যালারিতে। এখানে যে প্রিন্টমেকিং স্টুডিও আছে। সেখানে আরেকটি প্রদর্শনী হচ্ছে। যারা ওই স্টুডিওর সদস্য। যারা সেখানে প্র্যাকটিস করে। তাদের মোট ২০ জন এই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করছে। একই দিনে প্রদর্শনী ২ টি  শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের প্রিন্টমেকিংয়ের শুরু সফিউদ্দীন স্যারকে  দিয়ে। সে ধারা থেকে উনার ছেলে শিল্পী আহমেদ নাযীর খোকন, তার সহধর্মীণি শিল্পী নাহিদা শারমীনের চেষ্টায় তৈরি হয় ‘সফিউদ্দিন শিল্পালয়’, ‘সফিউদ্দিন আহমেদ সংগ্রহশালা’, ‘সফিউদ্দিন আহমেদ প্রিন্টমেকিং স্টুডিও’। মিউজিয়াম তৈরির উদ্দেশ্য হচ্ছে স্যারের কাজগুলোকে সংরক্ষণ করা। এর পাশাপাশি স্যারের কাজ মানুষকে দেখানো।  স্যার প্রিন্টমেকিংয়ে যেসব জিনিস ব্যবহার করতেন  সেসব জিনিসও এখানে সংরক্ষিত আছে। এখানে কেও আসলে এসব জিনিস দেখতে পারবেন। এমনকি উনি ফটোগ্রাফি করতেন। সেটা আমাদের অনেকের জানা ছিলনা। এখানে উনার ব্যক্তিগত জিনিস, ফটোগ্রাফির জিনিস,  প্রিন্টমেকিংয়ের উপকরণ রয়েছে। শিল্পী আহমেদ নাযীর খোকন, তার সহধর্মীণি শিল্পী নাহিদা শারমীন চিন্তা করলেন  এদেশে নতুনদের কাজের প্রসারের তেমন সুযোগ নেই। সেইসব তরুণরা যদি বছরে এখানে প্রদর্শনী করে, তাহলে তারা নতুন করে অনুপ্রাণিত হবে। পাশাপাশি সফিউদ্দীন স্যারের কাজও দেখতে পারবে।

শিল্পী আশরাফুল আলম রানা বলেন, ‘সফিউদ্দিন আহমেদ প্রিন্টমেকিং স্টুডিও’ তে অনেক তরুণরাই কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। ছাপচিত্র করতে গেলে বিভিন্ন উপকরণের দরকার হয়। বাসায় বসে সেগুলো করা যায় না। সেক্ষেত্রে এখানে কাজটি সম্পূর্ণ করা যায়। তাছাড়া ‘সফিউদ্দিন শিল্পালয়’ অনৈক তরুণরাই প্রদর্শনী করতে পারেন। যা তাদের জন্য একটি বড় সুযোগ।

প্রদর্শনী লকডাউনের কারণে আপাতত বন্ধ আছে। লকডাউন শেষ হলে প্রদর্শনীটি আবার দর্শকরা দেখতে পারবেন।

কোলকাতা ভবানীপুরের সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে শিল্পী সফিউদ্দীনকে জন্ম ১৯২২ সালের ২৩ জুন।  ১৯৪২ সালে শিক্ষাজীবন শেষ হয়। শিল্পী সফিউদ্দীন সার্থক চিত্রকর ও প্রিন্ট মেকার তো অবশ্যই, সেই সাথে অসাধারণ সংবেদনশীল একজন সার্থক শিক্ষকও। প্রত্যেক ছাত্রই ক্লাসে তাঁর কাছে ছিল সমান। ক্লাস বা পরীক্ষার নম্বর দেবার সময় জানতেও চাইতেন না এটা কার কাজ। একবার দেখেও তৃপ্ত হতেন না। পরের দিন আবার কাজগুলো বিছাতে হতো, আবার দেখতেন। তাঁর সব কিছুই নিখুঁতভাবে করার চেষ্টা ছিল।

১৯৪৬ সাল তাঁর জীবনের একটি স্মরণীয় দিন। কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টে শিক্ষক হিসাবে যোগ দিলেন। জীবনের নতুন একটি ধাপে পা রাখলেন। সেখানেও তাঁর একাগ্রতার স্বাক্ষর রাখলেন। শিল্পী সফিউদ্দীন উড এনগ্রেভিং ও এচিং-এর জন্যে বিখ্যাত হলেও তিনি কিন্তু প্রথম কাজের সম্মান পেয়েছিলেন তেলচিত্রে। ছাপচিত্রের পাশাপাশি তেল রং-এও কাজ করে যাচ্ছিলেন। তেল রং-এ ইমেপ্রশনিস্টদের ছাপ পাওয়া যায়। ‘শালবন’, ‘দুমকা’, ‘সূর্যালোকে কুটির’, ‘দুমকা-১’, ‘দুমকা-২’, ‘জড় জীবন’, ‘দিলীপ দাশগুপ্তের প্রতিকৃতি’ এই কাজগুলো সবই ছেচল্লিশের দিকের করা। বাহান্নর ‘ধানঝাড়া’ বা ছাপ্পান্নর ‘সূর্যমুখী’ও এই ধারার। দুমকার অসংখ্য স্কেচে ওদের সরল সাচ্ছন্দ্য জীবন, আকাশছোঁয়া প্রান্তর আর অপরূপ সাজের ছন্দময় প্রকৃতি এতো আলোড়িত করেছিল যে স্কেচগুলো তাঁর শিল্পীজীবনে সৃষ্টিশীলতায় নবজোয়ার এনে দিয়েছিল। যার প্রতিফলন তাঁর একুয়াটিন্ট ড্রাই পয়েন্টে দেখতে পাওয়া যায়। উড এনগ্রেভিং-এও সেই একই বিষয় আছে, কিন্তু মাধ্যমের কিছু ব্যবধানের কারণে, বাধ্যবাধকতায় কিছুটা ভিন্ন রূপ পেয়েছে। কিছু আছে আলোছায়ার খেলা।

১৯৪৫-এ ‘কবুতর’ (একুয়াটিন্ট মাধ্যমে) ছবির জন্যে পেয়েছিলেন একাডেমি প্রেসিডেন্টের স্বর্ণপদক। একাডেমি অব ফাইন আর্টস থেকে ১৯৪৬ সালে একুয়াটিন্টের জন্যে আরো একটি পুরস্কার। ১৯৪৬ সালে বিহার শিল্পকলা পরিষদ আয়োজিত প্রদর্শনীতে তখনকার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। দ্বারভাঙ্গা মহারাজা এ পুরস্কারটি প্রবর্তন করেছিলেন। দুই বছরে এতগুলো পুরস্কার তাঁকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। এই অর্জনের কারণে তাঁকে ১৯৪৬-৪৭ সালে অল ইন্ডিয়া আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস সোসাইটির কাউন্সিলর সদস্য করা হয়। দিল্লীতে সোসাইটির মূলকেন্দ্র ছিল। এটাও তাঁর জীবনের একটা বিরল অর্জন। শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে সবার সহযোগিতায় ও উদ্যমে ১৯৪৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হলো ‘গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্ট’। এদেশে চিত্রকলা চর্চার আন্দোলনের শুরু হলো। সবাই ব্রত হিসাবে নিলেন শিক্ষকতাকে। সফিউদ্দীন আহমেদ ছাপচিত্র বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে এই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করলেন। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এ তাঁর কাজের কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে ’৯০-এ করা কালো সিরিজের কালি, চারকোল, জলরঙে আঁকা ছবিগুলোয় বিরাট এক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ভাবতে অবাক লাগে এ বয়সেও তিনি তাঁর কাজে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন এনে চলেছেন। ১৯৬৩ তে চারুকলায় অবদানের জন্যে পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত ‘প্রেসিডেন্ট পদক’, ‘একুশে পদক’, ‘বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা’, ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার তিনি অর্জন করেছেন। তিনি অনেক উঁচুমাপের একজন মানুষ, একজন নিভৃতচারী শিল্পগুরু।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads