পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পে চীন সরকারের অর্থায়ন নিশ্চিত হলেও ঋণ চুক্তির আগেই দেখা দিয়েছে নতুন জটিলতা। ২০১৬ সাল থেকে চলমান প্রকল্পটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। যথাসময়ে কাজ শুরু না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে। একই সঙ্গে ব্যয় বাড়ছে ১২ দশমিক ২০ শতাংশ। এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই সেতু বিভাগ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
নতুন প্রস্তাবে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৫৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এর আগে ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সময়মতো কাজ শুরু না হওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে ৪ হাজার ২৬৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা। সংশোধিত প্রস্তাবের বিষয়ে আগামীকাল প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা ডেকেছে পরিকল্পনা কমিশন। সভার সুপারিশের ভিত্তিতে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবটি জাতীয় অথনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে উপস্থাপন করা হবে।
সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে সেতুটির উপর রেল লাইনসহ ১৬৯ কিলোমিটার রেল নেটওয়ার্ক বা নতুন রেললাইন নির্মাণ করা হবে। কয়েকটি জেলা নতুন করে রেলওয়ের আওতায় আসবে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ। এ পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ক্রমপুঞ্জীভূত ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা।
চলমান প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল জানুয়ারি ২০১৬ থেকে জুন ২০২২ সাল পর্যন্ত। ব্যয় ধরা ছিল ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, এর মধ্যে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে চীন সরকার ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা এবং বাকি ১০ হাজার ২৩৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে আসার কথা। কিন্তু সংশোধনীতে প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে জুন-২০২৪ সাল পর্যন্ত করার কথা বলা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, পিইসি সভায় প্রকল্পের বিভিন্ন অঙ্গের প্রস্তাবিত সংশোধিত ব্যয় নিয়ে আলোচনা করা হবে। পাশাপাশি ব্যয়ের যৌক্তিকতা ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণ বিষয়ক রেল মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যাও শোনা হবে। একই সঙ্গে মেয়াদ দুই বছর বাড়ার যৌক্তিকতাও জানতে চাইবে কমিশন।
এদিকে ২০১৮ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর মূল কাজ শেষ করার লক্ষ্য থাকলেও তা কিছুটা পেছাবে। এ পর্যন্ত সেতুটির কাজ হয়েছে প্রায় ৫৩ শতাংশ। এর মধ্যে স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে সড়ক সেতুর ৪৫০ মিটার দৃশ্যমান হয়েছে। এ অবস্থায় পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ প্রকল্পের বর্তমান যে অবস্থা, তাতে একই সময়ে সড়কে গাড়ি ও রেল চলাচল শুরু করার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। রেলপথ চালু করতে হলে এর সঙ্গে প্রকল্পের মধ্যে দীর্ঘ ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ ও কয়েকটি ছোট-বড় রেল সেতুর নির্মাণও শেষ করতে হবে। অথচ এ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ হয়েছে মাত্র ১০ শতংশ।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু প্রকল্প পরিদর্শনে গিয়ে সড়ক সেতু চালুর দিন থেকেই রেল চলাচলও উদ্বোধনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে রেল মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি চিঠি পাঠায়। তাতে বলা হয়েছিল, ২০১৯ সালে পদ্মায় রেল সেতু উদ্বোধন করতে হলে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু করতে হবে। মে-জুন মাস থেকে বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ায় জানুয়ারি মাস থেকে কাজ শুরু করতে হবে। না হলে পদ্মা সড়ক ও রেল সেতু একসঙ্গে উদ্বোধন করা সম্ভব হবে না।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের পাঠানো প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় জমি অধিগ্রহণ, বেতন-ভাতা ও নির্মাণ খাতের ব্যয় বাড়ার কারণে মূল প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়ছে। এর মধ্যে ৮৬ একর অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ৩ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা, বেতন ও ভাতায় ১২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, বাস্তবায়ন ইউনিটে অন্যান্য ইনফুটের ব্যয় ১৩১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা বৃদ্ধি এবং নির্মাণ খাতে ৯৫৯ কোটি ৫ লাখ টাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করে মন্ত্রণালয়।
এদিকে আগামী ২৮ এপ্রিল চীনের বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এ প্রকল্পের বহুল প্রতীক্ষিত ঋণ চুক্তি। এ বিষয়ে রোববার বিআইজিএম ভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক বলেন, পদ্মা সেতুর ওপর রেলসংযোগ প্রকল্পের ঋণ চুক্তি ২৮ এপ্রিল সই হবে। চীনের বেইজিংয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষর হবে। সে দেশের এক্সিম ব্যাংক এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, সরকারকে এ প্রকল্পে প্রিফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিটে ঋণ নিতে হচ্ছে। এ ঋণের সুদ ধরা হবে ২ শতাংশ। তবে এর সঙ্গে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে দিতে হবে প্রতিশ্রুতি ও ব্যবস্থাপনা ফি (দুটি মিলে ০.৫ শতাংশ)। এর মধ্যে ব্যবস্থাপনা ফির ৬৬ লাখ ৬৯ হাজার ৮৪৩ ডলার পরিশোধ করতে হবে চুক্তি হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে। ঋণ পরিশোধ করতে হবে ২০ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে রেয়াতকাল ৬ বছর।
ইআরডির অতিরিক্ত সচিব মো. জাহিদুল হক বলেন, যথাসময়ে প্রকল্পটির কাজ ত্বরান্বিত করতে গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে চীনের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করতে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে আগামী ২৮ এপ্রিল চুক্তির সম্ভাব্য দিন ঠিক করা হয়েছে। তা দুই-এক দিন আগে বা পরেও হতে পারে। চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ইআরডি ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ৬ সদস্যের প্রতিনিধিদল বুধ-বৃহস্পতিবার চীন যাচ্ছেন।