• শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪২৮

যোগাযোগ

প্রস্তাবিত পরিবহন আইন উসকে দিয়েছে বিতর্ক

*মালিক-শ্রমিকের স্বার্থ দেখা হবে  *সঠিক প্রয়োগ দুর্ঘটনা কমাবে

  • শরীফ খিয়াম
  • প্রকাশিত ২৬ এপ্রিল ২০১৮

প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইন সংসদে উত্থাপনের সরকারি ঘোষণা উসকে দিয়েছে বিতর্ক। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতে, নতুন আইন সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারবে না। তবে বাংলাদেশ পরিবহন মালিক সমিতির অভিমত, আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে দুর্ঘটনা অবশ্যই কমবে। সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় অবশ্য যাত্রী, মালিক, সরকার সব পক্ষই উদ্বিগ্ন। প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের কার্যক্রমও।

বর্তমানে দেশের পরিবহন খাত চলছে ভারতীয় মোটরযান আইন-১৯৩৯-এর পরিমার্জিত রূপ ‘মোটরযান অধ্যাদেশ-১৯৮৩’ অনুযায়ী। অবশেষে হালে পানি পাচ্ছে এটি সংস্কারের উদ্যোগ। চলতি সপ্তাহের শুরুতে আইনমন্ত্রী জানান, দুর্ঘটনা কমাতে আসন্ন বাজেট অধিবেশনেই প্রস্তাবিত ‘সড়ক পরিবহন আইন’ সংসদে (জুন মাসে) তোলা হবে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘এই আইন সড়কে বিশৃঙ্খলা-নৈরাজ্য আরো বাড়াবে। কারণ এটি নিয়ে সরকার মূল স্টেকহোল্ডার যাত্রীদের সঙ্গে কোনো আলোচনাই করেনি।’

তবে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, তারা এটি নিয়ে সব ধরনের স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছেন।  মোজাম্মেল বলেন, ‘আইনে যেসব কমিটির কথা বলা আছে, তাতে শুধু মালিক-শ্রমিকদের প্রতিনিধি থাকবেন। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের কায়েমি স্বার্থ লুফে নেবেন, জনস্বার্থ বিঘ্নিত হবে।’ আইনমন্ত্রীর দাবি, ‘এটা ঢালাওভাবে বলা যাবে না। আমরা চেষ্টা করছি আইনে সড়ক পরিবহনের ‘এ টু জেড’ সবকিছু দেখার।’

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘নতুন আইনটি বেশ কড়া। এতে শাস্তি ও জরিমানা অনেক বেশি রাখা হয়েছে। এর প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে দুর্ঘটনা অবশ্যই কমবে।’ তার অভিমত, শুধু পরিবহন মালিক-শ্রমিক নিয়ন্ত্রণে আইন করলে হবে না, সার্বিক সচেতনতা বৃদ্ধিও খুব দরকার। যাত্রী-পথচারীকেও সচেতন করতে হবে।

অন্যদিকে বিদ্যমান আইন ঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনা যেত দাবি করে মোজাম্মেল বলেন, ‘ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে সবাই আইন মেনে গাড়ি চালায়। কারণ সেখানে আইনের কার্যকর প্রয়োগ আছে। আর বাইরে আইন প্রয়োগকারী ট্রাফিক পুলিশ পকেটে পয়সা ঢোকাতে ব্যস্ত।’

বাংলাদেশের রাস্তায় বর্তমানে প্রায় ৫০ লাখ যানবাহন চলছে, যার ৭২ শতাংশের ‘ফিটনেস’ নেই। লাইসেন্স আছে মাত্র ৩১ লাখের। আর মোট ৭০ লাখ চালকের মধ্যে বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী মাত্র ১৬ লাখ। চলতি সপ্তাহে ঢাকায় এক গোলটেবিল বৈঠকে এ তথ্য জানিয়ে মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে আমরা যে জরিপ চালিয়েছি, তারই অংশবিশেষ তুলে ধরা হয়েছে।’ তার দাবি, ‘অধিকাংশ স্থলযান আইন লঙ্ঘন করে বেপরোয়াভাবে চলাচল করায় দেশে দুর্ঘটনা ক্রমে বাড়ছে। মানুষ ঘর থেকে রাস্তায় বের হয়ে নিরাপদ বোধ করছে না।’

অন্যদিকে দুর্ঘটনা বৃদ্ধির কারণ উদ্ঘাটন করতে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিও কাজ শুরু করেছে। সংগঠনের মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘সড়কে নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য যে চালক-শ্রমিকরা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অ্যাকশনে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে।’ তিনি জানান, দুর্ঘটনা কমানোর জন্য প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সুপারিশ করেছেন তারা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) গবেষণা মতে, দেশের ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতির জন্য এবং শুধু চালকের বেপরোয়া মনোভাবে ঘটে আরো ৩৭ শতাংশ। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভাপতি, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও গত সপ্তাহে বলেন, ‘চালকদের আরো সচেতন হতে হবে।’ রাজধানীতে দুই বাসের গতির প্রতিযোগিতায় হাত হারানো কলেজছাত্র রাজীব হোসেনের মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আরো বলেন, ‘এটা হয়েছে পরিবহন অব্যবস্থাপনা, চালকদের অসচেতনতা ও রেষারেষির কারণে।’

ঢাকার ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত বলে দাবি যাত্রী কল্যাণ সমিতির। তবে মালিক সমিতির এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘পর পর কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটাতে এভাবে বলা হচ্ছে; কিন্তু এটা মনগড়া।’ তার মতে, ‘ঢাকায় অদক্ষ ড্রাইভার বেশি। আবার ট্রিপভিত্তিক চুক্তিতে চলা বাসের সংখ্যাও এখানে কম নয়। যে কারণে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে।’ যাত্রী সমিতি বলছে, সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। একই সঙ্গে পঙ্গুত্বের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে আরো দেড় শতাধিক। মোজাম্মেল বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশে করা হেলথ ইনজুরি সার্ভে-২০১৬’র ভিত্তিতে এ কথা বলা হয়েছে।’ ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন বহু মানুষ প্রাণ হারালেও এর মধ্যে খুব অল্পই গণমাধ্যমে উঠে আসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয় না।’

সংবাদের ভিত্তিতে যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী, এ বছর জানুয়ারি থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ৭৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৮৪১ মানুষের প্রাণ গেছে। একই প্রক্রিয়ায় তৈরি নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির জরিপ মতে, গত বছরের ৩০ এপ্রিল অবধি দেশে ১ হাজার ৩৭২টি দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ১ হাজার ৫৫২ জন মারা গিয়েছিল। বেসরকারি হিসাবে, ২০১৭ সালে দেশে ৪ হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৭ হাজার ৩৯৭ জন। এর আগে ২০১৬ সালে ৪ হাজার ৩১২টি দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৫ জন নিহত হয়। আর সরকারি হিসাবে, গত ১০ বছরে এ কারণে মারা গেছে মোট ৩৪ হাজার ৯১৮ জন। থানায় মামলাভুক্ত দুর্ঘটনার এই পরিসংখ্যানের গড় অনুযায়ী বছরে ৩ হাজার ৪৯১ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। যদিও বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ১২ হাজার মানুষের আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রায় ২০ হাজার জনের।

পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, দুর্ঘটনার ৩১ দশমিক ৮৭ শতাংশই ঘটছে বাসে, ২৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ ট্রাকে। বাকি ৩৮ শতাংশের কারণ প্রাইভেটকার, জিপ, ট্যাক্সি ও মোটরসাইকেল। দুর্ঘটনা কমাতে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের কোনো চেষ্টা নেই জানিয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, ‘সরকার সব সিদ্ধান্ত নিতে চায় মালিক-শ্রমিককে খুশি করে।’

৬ মন্ত্রী, ১১ সচিবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও পরিবহন খাতের শীর্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত এই কাউন্সিলের সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘যারা কাউন্সিলের মূল কর্তা, তারাই এর হর্তা-কর্তা-বিধাতা, আমি সিভিল সোসাইটির সামান্য প্রতিনিধি মাত্র। আমার অনেক কিছুই বলার আছে, কিন্তু সুযোগ কই? গত ছয়-সাত মাসে কাউন্সিলের কোনো বৈঠক হয়নি।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads