বরিশালের ‘ত্রাস’ সেরনিয়াবাত পরিবারের সবাই পলাতক
জে আই জুয়েল, বরিশাল
প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১:৫২
সেরনিয়াবাত পরিবারের কয়েকজন সদস্য। ছবি : সংগৃহীত
চার দশক ধরে একটি পরিবারের হাতে ছিল বরিশাল আওয়ামী লীগের চাবিকাঠি। দল ক্ষমতায় থাকার সুবাদে সেরনিয়াবাত পরিবারের কথায় চলত বরিশাল। আর এসবের গোড়ায় ছিলেন পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাত ভাই আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ সেরনিয়াবাত। শুধুমাত্র শেখ পরিবারের আত্মীয় হওয়ায় জেলায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিল সেরনিয়াবাত পরিবার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগনে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ প্রায় চার দশক ধরে বরিশাল অঞ্চল একক আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। তার নির্বাচনী এলাকা গৌরনদী-আগৈলঝাড়ায় অন্য দলের রাজনীতি একরকম ‘নিষিদ্ধ’ ছিল বলা যায়। ফলে নির্বাচনে তার বা সেরনিয়াবাত পরিবারের লোকদের প্রতিদ্বন্দ্বী কাউকে পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে সব নির্বাচনেই ডামি প্রার্থী দিয়ে ভোটের আয়োজন করা হয়েছিল। দলের ভেতর-বাইরে তার সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ ছিলেন চারবারের সংসদ সদস্য (এমপি)। তার ভাই ও ছেলে দুজনেই মেয়র। উপজেলা ও পৌরসভাসহ আওয়ামী লীগের পদ-পদবি সবকিছুই ছিল এই পরিবারের করায়ত্তে। এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে কে কোন পদে থাকবেন সেটাও নির্ভর করত এই পরিবারের ইচ্ছার উপর।
হাসনাত আব্দুল্লাহর ছোট ভাই খোকন সেরনিয়াবাত সর্বশেষ বরিশালের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধেও ২০০ কোটি বা তার অধিক টাকা লুটপাটের অভিযোগ। যদিও হাসানাত পরিবারের সঙ্গে তার চরম বৈরী সম্পর্ক। নগরীতে হাসানাত-বিরোধী বলয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন খোকন সেরনিয়াবাত। তাদের বাবা আবদুর রব সেরনিয়াবাত বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। তিনি পঁচাত্তর ট্র্যাজেডিতে নিহত হয়েছিলেন।
সেরনিয়াবাত পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিলেন হাসনাত আব্দুল্লাহ বড় ছেলে সাদিক আব্দুল্লাহ। ২০১৮ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সাদিক মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও গ্রহণ করেন। এরপর থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠেন সাদিক। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, সম্পত্তি দখল ও নিয়োগ বাণিজ্যের অসংখ্য অভিযোগ উঠে।
মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তার বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে শুরু করে। নগরীর নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণের কারণে ব্যবসায়ীদের উপর চাপ সৃষ্টি করে তিনি মোটা অঙ্কের কমিশন আদায় করতেন। সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ ও অন্যান্য দপ্তরের মাধ্যমে ফ্ল্যাট ও কমিশন নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু দুর্নীতি নয়, প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে তার দাপটে তটস্থ ছিল বরিশালের প্রশাসনও। যার প্রমাণ ওই সময়ের জেলা প্রশাসক জসিমউদদীন হায়দার। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনিবুর রহমান এবং সাবেক এমপি জাহিদ ফারুকের সাথে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব জড়িয়েছেন।
বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে মহানগর কমিটি পুনর্গঠন করেন। যেখানে তার পছন্দের ব্যক্তিরাই স্থান পান। আর সিটি কর্পোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিজের সমর্থকদের নিয়োগ দিয়ে পুরো প্রশাসনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখেন। বরিশাল নগরী ও আশপাশের অঞ্চলে একক রাজত্ব গড়ে তোলেন।
সেরনিয়াবাত পরিবার সর্বশেষ দাপট দেখায় গেল উপজেলা নির্বাচনের সময়। হাসানাত আব্দুল্লাহর ছোট ছেলে সেরনিয়াবাত আশিক আবদুল্লাহকে উপজেলা চেয়ারম্যান বানাতে ব্যাপক রদবদল ঘটানো হয় দুই উপজেলা ও পৌরসভায়। আগৈলঝাড়ার সেরাল গ্রামের বাড়িতে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আশিক আবদুল্লাহ নিজেকে চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা করেন। দলের সাধারণ সম্পাদকসহ বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী এ সময় উপস্থিত ছিলেন। তার ঘোষণার পর উপজেলার ভোটে নতুন মোড় নেয়। আশিকের বিরুদ্ধে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন অনেকেই। হাসানাত আবদুল্লাহসহ তার দুই ছেলে আশিক আবদুল্লাহ ও মঈন আবদুল্লাহর ছবি লাগিয়ে প্রচারণা চালানো হয় সেই সময়।
বরিশাল আওয়ামী লীগের মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা কমিটি গঠিত হয়েছিল ২০১২ সালের ২৭ ডিসেম্বর। কমিটিতে হাসানাত আবদুল্লাহ জেলার সভাপতি ও তার বড় ছেলে সাবেক মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ মহানগরের সাধারণ সম্পাদক। এছাড়াও হাসনাত আব্দুল্লাহর দুই ছেলে মঈন আবদুল্লাহ ও আশিক আবদুল্লাহ এবং চাচাতো ভাই রুস্তম সেরনিয়াবাত জেলার সদস্য। শ্যালক কাজী মফিজুল ইসলাম কামাল কোষাধ্যক্ষ। হাসানাতের প্রয়াত স্ত্রী সাহান আরা আবদুল্লাহ ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। আর সাদিকের স্ত্রী লিপি আবদুল্লাহ মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য।
শোনা গেছে, হাসানাত আব্দুল্লাহ বর্তমানে ভারতে তার মেয়ের কাছে আছেন। সাদিক ও আশিক আব্দুল্লাহসহ এই পরিবারের সবাই পলাতক। শুধু গত ২৫ অক্টোবর হাসনাত আব্দুল্লাহর মেজ ছেলে মঈন আব্দুল্লাহকে ঢাকার গুলশান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার আবুল হাসানাত আবদুল্লাহসহ তার পরিবারের ৭ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে। একইসঙ্গে তার পরিবারের সদস্যদের নামে ব্যক্তি মালিকানাধীন বা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবও স্থগিত রাখতে বলা হয়।
হাসানাত আবদুল্লাহর প্রয়াত স্ত্রী সাহান আরা আবদুল্লাহ ও তার তিন ছেলে মঈন আবদুল্লাহ, সাদিক আবদুল্লাহ ও আশিক আবদুল্লাহর ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়াও সাদিক আব্দুল্লাহর স্ত্রী লিপি আব্দুল্লাহ ও তাদের পরিবারের আরেক সদস্য ফিরোজা সুলতানা ব্যাংক হিসাবও স্থগিত করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠিয়ে হিসাব জব্দ করা হয়।
হাসনাত আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে আগৈলঝারা ও গৌরনদী এলাকায় জমি দখলের অভিযোগ করেছেন স্থানীয় যুবলীগ নেতা। এর আগে, গত ৪ অক্টোবর ছাত্রদল নেতাকে হত্যার অভিযোগে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। ভুক্তভোগীর ছেলে আশিকুর রহমান বরিশাল জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। বিচারক মোখলেচুর রহমান অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের জন্য আগৈলঝাড়া থানার ওসিকে নির্দেশ দেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বরিশালে এটাই প্রথম হত্যা মামলা। মামলায় বরিশাল আওয়ামী লীগের নেতা, সাবেক রেঞ্জ ডিআইজ, পুলিশ সুপার, পুলিশ কর্মকর্তাসহ ১৪ জন এবং অজ্ঞাত আরও ৪০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
ওএফ/এমএইচএস