-677950f327fbb.jpg)
ছবি : বাংলাদেশের খবর
খেজুর রস আর গুড় ছাড়া শীতকাল পানসে লাগে। সেই রসগুড়ের বড় একটি অংশ উৎপাদন হয় দেশের দক্ষিণের জেলা ঝিনাইদহে। প্রতিবছর ঋতু পরিক্রমায় শীত এলেই রস সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এ জেলার গাছিরা। এ বছরও ঝিনাইদহে শুরু হয়েছে শীতের খেজুরের রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির প্রক্রিয়া।
প্রতিদিন গাছিরা খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তা থেকে সুস্বাদু গুড় তৈরি করছেন। গুড়ের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় বাজারে দামও বেড়েছে। স্থানীয় হাট-বাজারে খেজুর গুড় প্রতি কেজি ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। জেলার ছয় উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে উৎপাদিত গুড় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে চলে যায়।
প্রতি সপ্তাহে ব্যবসায়ীরা জেলার বিভিন্ন এলাকার ছোট বড় বাজার থেকে এসব গুড় কিনে বড় বড় শহরে পাঠিয়ে দেন। এতে এ অঞ্চলের কৃষকরা যেমন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন অন্যদিকে পুষ্টি চাহিদা পূরণে বিরাট ভূমিকা রাখছে ঝিনাইদহের উৎপাদিত খেজুর গুড়।
তবে রস সংগ্রহ থেকে শুরু করে গুড় তৈরি পর্যন্ত একজন গাছি ও তার পরিবারের সদস্যদের হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়। গাছ তোলা ও গাছ কাটতে একজন গাছির পরিশ্রমের শেষ থাকে না।
বিকেলে গাছ কাটার পর রাত শেষে কনকনে শীত উপেক্ষা করে গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে বাড়িতে আনতে হয়। এরপর গৃহিণীরা অনেক কাঠখড়ি পুড়িয়ে গুড় তৈরি করেন। বর্তমান সময়ে মানুষ আর গুড় তৈরির মতো কঠোর পরিশ্রম করতে চান না। ফলে দিনে দিনে গাছের সঙ্গে সঙ্গে গাছিও কমে যাচ্ছে।
এদিকে, খেজুর গুড়ের দাম ও চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী চিনি, আখের গুড়, আটা ও ফ্লেবার দিয়ে ভেজাল গুড় তৈরি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলা মামুনশিয়া গ্রামের বাসিন্দা বাদশা মিয়া বলেন, প্রতি বছরের মতো এ বছর গুড় তৈরি শুরু হয়েছে। এখানকার গুড়ের স্বাদ অসাধারণ। এ বছর যশোর থেকে কিছু গাছি এসে মামুনশিয়া বকুলতলা মাঠে খেজুরগাছ ভাড়া নিয়ে গুড় উৎপাদন করছেন ‘
গাছি আব্দুল কাদের বলেন, আমরা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে প্রতিদিন গুড় উৎপাদন করছি। তবে গাছ ভাড়া ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে প্রতি কেজিতে ৫০ থেকে ৭০ টাকা দাম বেড়েছে। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি গুড় বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা দরে। ১০ কেজি রস জ্বালিয়ে এক কেজি খাঁটি খেজুরের গুড় তৈরি হয়।
ডাকবাংলার ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন বলেন, শীত মৌসুমে খেজুরের গুড় আমাদের অঞ্চলের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখে। তবে আধুনিক পদ্ধতি ও প্রশিক্ষণের সুযোগ পেলে গাছিরা আরও বেশি লাভবান হতে পারবেন। গাছিরা মনে করেন, সরকারি প্রষ্ঠপোষকতা পেলে ঝিনাইদহের গুড় উৎপাদন আরও বাড়বে। অন্যদিকে নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা গুড় তৈরির কাজে খুব একটা আগ্রহী নয়। বিভিন্ন লাভজনক ব্যবসা ও আধুনিক চাষাবাদ করে বেশি পরিমাণ লাভের কারণে গুড় তৈরির কাজ দিন দিন কমে যাচ্ছে।
স্থানীয়দের ভাষ্য, শীত এলেই ঐতিহ্যবাহী নানা রকম পিঠা পায়েসের ধুম পড়ে ঝিনাইদহের ঘরে ঘরে। একদিকে যেমন খেজুরের রস সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েন গাছিরা, অন্যদিকে জেলার প্রতিটা ঘরে ঘরে পিঠা পায়েস তৈরির প্রধান উপকরণ চালের গুড়া তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন গৃহিণীরা।
শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রস ও গুড়ের তৈরি ভাপা পিঠা, পুলিপিঠা, পাটিসাপটা, রসে ভেজা পিঠাসহ নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে। এ সময় বিভিন্ন শহরে থাকা আপনজন ও আত্মীয়রা শখ করে ঝিনাইদহে আসেন মৌসুমি পিঠা পায়েস খাওয়ার জন্য। তবে আশঙ্কাজনকভাবে ইট ভাটার জ্বালানি হিসেবে খেজুর গাছ ব্যাবহৃত হওয়ায় বিলুপ্তির পথে এ গাছ।
শৈলকুপা উপজেলার সাংস্কৃতিক কর্মী আলমগীর অরণ্য বলেন, শীতের ঐতিহ্য হলো খেজুরের রস ও গুড়। রস গুড় ছাড়া শীত কল্পনাতিত। শীতের আড়াই থেকে তিন মাস খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা যায়। যত বেশি শীত পড়বে, রস তত বেশি মিষ্টি ও পরিষ্কার হয়।
মহেশপুর উপজেলার স্কুল শিক্ষক আব্দুর রব বলেন, জামাই-মেয়ে ঢাকা থাকে। শীতের পিঠা খেতে আমার বাড়িতে এসেছে। কিন্তু আগের মতো এখন খেজুর গুড় ও পাটালি পাওয়া যায় না। খুব কষ্ট করে পরিচিত এক গাছির কাছ থেকে গুড় পেয়েছি। পাটালি বাজার থেকে কিনতে হয়েছে।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলা কৃষি অফিসার মো. নূর-এ-নবী বলেন, এবারের শীতে আগের মতো খেজুর গাছ কাটতে দেখা যায় না। গাছ কমে গেছে। প্রতি বছরই কৃষকদের সাথে নিয়ে কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় গাছের চারা রোপণ করা হয়। খেজুর গাছ, রস গুড় তৈরি এখন ইতিহাস ঐতিহ্য হয়ে পড়েছে।
এদিকে, জেলা কৃষি বিভাগ খেজুর গাছ সংরক্ষণ ও নিরাপদ গুড় উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। গত ২৭ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ সদর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে সুগার ক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১০০ জন গাছিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
ঝিনাইদহ জেলা কৃষি অধিদপ্তরের উপপরিচালক ষষ্টি চন্দ্র রায় বলেন, ঝিনাইদহে বর্তমানে ১ লাখ ৪০ হাজারের মতো খেজুর গাছ রয়েছে। আমরা খেজুর গাছের চারা রোপণে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি। খেজুর গাছের চারা রোপণকারী ও নিরাপদ গুড় উৎপাদনকারীদের পুরস্কারের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
এম বুরহান উদ্দীন/এমজে