Logo
Logo

সারাদেশ

ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে কোটি টাকা লোপাট

Icon

জেআই জুয়েল, বরিশাল

প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮:২৪

ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে কোটি টাকা লোপাট

ছবি : সংগৃহীত

বরিশালের বাবুগঞ্জে ২০২২ থেকে ২০২৫ অর্থবছরে প্রকল্প গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ, বিশেষ টি.আর কাবিখা ও কাবিটা কর্মসূচির প্রায় পাঁচ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে।

এসব প্রকল্পে কাজ না করেই বাবুগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. নাসির উদ্দিনকে প্রকল্পের ২০ ভাগ টাকা দিয়েই উত্তোলন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। 

জানা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের বিশেষ টি.আর কর্মসূচির মাধ্যমে নগদ ১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এতে বিভিন্ন এলাকার মসজিদ, মাদ্রাসা, রাস্তা ঘাট মেরামত ও উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই সময় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের আরও একটি বিশেষ টি.আর কর্মসূচির মাধ্যমে ৬ টি রাস্তার প্রকল্পে (কাবিটা) ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

এসব কাজে পিআইও নাসির উদ্দিনকে প্রকল্পের ২০ ভাগ টাকা দিয়ে কাজ না করেই টাকা উত্তোলন করো হয়েছে। এছাড়াও বরিশাল জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে ঘূর্ণিঝড় মোখা নামে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বিশেষ বরাদ্দ এনে পিআইও নাসির উদ্দিন নিজেই করেছেন লুটপাট। যাতে রয়েছে নগদ টাকা, শুকনা খাবার ও ১০৯ মেট্রিক টন চাল। এসব বরাদ্দ কোনো অসহায় ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠান পায়নি। সরকারি মূল্যে ওই চালের দাম ৫১ লাখ টাকা।

এছাড়াও ২০২৩ সালের শেষের দিকে তৎকালীন আওয়ামী লীগের উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী এমদাদুল হক দুলাল গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ টি.আর কর্মসূচির মাধ্যমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের থেকে ৪৭ লাখ ৮০ হাজার এবং বরিশাল জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে এই প্রকল্পে ৩২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু যেসব মসজিদ, মাদ্রাসার নাম ব্যবহার করা হয়েছে সেই প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বাস্তবে নেই। রাস্তা ও কালভার্ট নির্মাণ করার কথা থাকলেও। কোথাও কাজ দেখা যায়নি। প্রকল্পের ২০ ভাগ টাকা পিআইও নাসির উদ্দিনকে দিয়েই টাকা উত্তোলন করছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ইউপি সদস্য বলেন, ‘সকল অনিয়ম হয় উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা ও কর্মচারির মাধ্যমে। কাজ যতই ভালো করি না কেনো বিলের ২০ ভাগ পিআইওকে না দিলে বিল পাশ হয় না। তাহলে কীভাবে কাজ করব বলেন? তার থেকে ২০ থেকে ২৫ ভাগ টাকা দিয়ে কাজ না করেই বিল তুলতে পারি। তাহলে কেন কাজ করব? কর্মকর্তা টাকা পেলে সব অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করে। কারণ মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন করার দায়িত্ব তাদের বিগত দিনগুলোতে যেভাবে কাজ হয়েছে এবারও তাই হয়েছে।’

উপজেলা নির্বাহী কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে দুর্যোগ অধিদপ্তরের টি.আর কর্মসূচির মাধ্যমে নগদ প্রায় দুই কোটি (২) টাকা বরাদ্দ আসে। কিন্তু পিআইও নাসিরের দুর্নীতি কথা সাবেক উপজেলা নির্বাহী শাকিলা রহমান জেনে গেলে ৮০ লাখ টাকা আটকে দেন এবং সবগুলো প্রকল্প সে নিজে পরিদর্শন প্রকল্পে কাজ না হওয়ায়। পিআইও নাসিরকে সতর্ক করেন। বরাদ্দকৃত টাকা থেকে ৮০ লাখ টাকা অধিদপ্তরে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। এ নিয়ে পিআইও নাসিরের সাথে সাবেক উপজেলা নির্বাহী শাকিলা রহমানের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।’

এ বিষয়ে কেদারপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুম মৃধা বলেন, ‘২০২৩ সালের শেষের দিকে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ কাবিটা কর্মসূচির মাধ্যমে জনতার বাজার থেকে পূর্ব কেদারপুর স্কুল পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার জন্য ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকায় কাজ করেছি। কিন্তু প্রকল্প পাশ করাতে লেগেছে প্রকল্পের ২০ ভাগ টাকা এবং পিআইওর ২৫ ভাগ টাকা না দিলে বিল পাশ হবে না। বরাদ্দের ৫৫ ভাগ দিয়ে এবং ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে ৩০ ভাগ কাজ করা কী সম্ভব বলেন? এরপর ১০০ ভাগ কাজ করলেও পিআইওর ২৫ ভাগ টাকা ছাড়া বিলে স্বাক্ষর করেন না। তাই ৫ থেকে ১০ ভাগ কাজ করে পিআইও নাসিরকে ২৫ ভাগ টাকা দিয়ে বিল উত্তোলন করেছি। অনেক সিপিসি ১ ভাগ কাজও করেনি। তারাও বিল নিয়ে গেছে।

রাহুতকাঠি গ্রামীণ ব্যাংকের সামনে মাটি ভরাট ও রাহুতকাঠি বাজার জামে মসজিদের সংস্কার ২ লাখ ৪৯ হাজার ৩৫২ টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু প্রকল্পের সিপিসি মো. জসিম উদ্দিন জানেন না ।

তিনি বলেন, ‘আমি বরাদ্দের বিষয়ে কিছু জানি না, পিআইও নাসির আমাকে তার অফিসে ডেকে স্টাম্পে স্বাক্ষর নেন এবং তৎকালীন চেয়ারম্যান কাজী ইমদাদুল হক দুলাল আমাকে দুই প্রকল্পের কথা বলে ৫০ হাজার টাকা দেন। সেই টাকা দিয়ে রাহুতকাঠি গ্রামীণ ব্যাংকের সামনে মাটি ভরাট করেছি এবং মসজিদে সামান্য কাজ করেছি।’

মাধবপাশা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নাসির গত অর্থ বছরের জুন মাসে ঘূর্ণিঝড় মুখার নামে ৬ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সিপিসি করে চাল উত্তোলন করেছেন ১০৯ মেট্রিক টন। চেয়ারম্যানদের আংশিক কিছু দিয়েই বাকি সব তিনি আত্মসাৎ করে বিক্রি করেছেন।’

সম্প্রতি নাসির আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে বাবুগঞ্জ থেকে তাকে বদলি করা হয় ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায়। কিন্তু বদলির দুই মাসেও তিনি বাবুগঞ্জ ছেড়ে যায়নি। বদলি ঠেকানোর জন্য বার বার ঢাকায় তদবির করছেন তিনি। বদলির পরও থেমে নেই নাসির ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের ডিসেম্বরে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা ও মাহফিলের নামে জিআর (চাল ও গম) এনেছে। কিন্তু যে সব প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যবহার করা হয়েছে তারা নিজেরাও জানেন না। 

রোববার (৫ জানুয়ারি) বিভিন্ন প্রকল্পে ঘুরে দেখা গেছে, রহমতপুর কৃষি গবেষণার পশ্চিম দক্ষিণ কোনা থেকে নূর মোহাম্মদ হাওলাদারের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ ও রহমতপুর কৃষি গবেষণার পশ্চিম পাশ থেকে কৃষি কলেজগামী রাস্তার বাকী অংশের কাজ সমাপ্তকরণে ছয় লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও কোনোও কাজের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। 

ওই কাজের সিপিসি নাইম রেজার কাছে কাজের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিসে ২৫ ভাগ টাকা দিয়ে আসলে কাজ করতে হবে না এই মর্মে।’

অভিযুক্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘ এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে রাজি নই।’

বাবুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আমি এ উপজেলায় নতুন এসেছি প্রকল্পের বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে, লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ নেব।’ 

এ বিষয়ে বরিশাল জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা রনজিৎ কুমার সরকার বলেন, ‘প্রকল্পের অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করে সত্যতা পেলে তার বিরুদ্ধে সরকারি বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 

 জেআই জুয়েল/এমআই

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর