Logo

সারাদেশ

মরতে বসা শিল্পে ২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান

Icon

নওগাঁ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩:২৬

মরতে বসা শিল্পে ২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান

ছবি : বাংলাদেশের খবর

গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী হিসেবে দেখা যেত কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্র। টেকসই ও দাম কম হওয়ায় নানা অনুষ্ঠানে এসব সামগ্রী উপহার দেয়ারও প্রচলন ছিল। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় কাঁসা-পিতলের বাসন-কোসন ব্যবহারে ভাটা পড়েছে। ফলে সময়ের সঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়েছে এ শিল্প।

নওগাঁ শহরের দপ্তরি পাড়ায় শেখ শিল্পালয় কারখানায় কাজ করছেন প্রায় ১৫০ জন শ্রমিক। কেউ পিতলের পাত সাইজ করে কাটছেন, মুখ জোড়া দিচ্ছেন, কেউ আগুনে পোড়াচ্ছেন আবার কেউ ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করে চুড়িতে সোনার রং দিচ্ছেন। দেখে মনে হতে পারে কোনো সোনার খনিতে কাজ করছেন শ্রমিকরা।

এখানে সোনার বিপরীত ধাতু পিতল থেকে তৈরি হচ্ছে হাতের চুড়ি বা বালা। যা রুলি বালা হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে ব্যাপক কদর বেড়েছে পিতল থেকে তৈরি এ চুড়ির। সোনার দাম যতই বাড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য পিতলের তৈরি এ গহনাটির চাহিদাও বাড়ছে। প্রতিমাসে নওগাঁয় ৫টি কারখানা থেকে প্রায় কোটি টাকার এসব চুড়ি উৎপাদন হচ্ছে।

জানা গেছে, ২০১২ সাল থেকে জেলায় পিতল দিয়ে চুড়ি বা রুলি বালা তৈরির কার্যক্রম শুরু হয়। পিতলের চুড়ি বা রুলি বালা তৈরির জন্য এ কাঁচামালটি ঢাকা থেকে নিয়ে আসা হয়। এটি মূলত চায়না পিতলের পাত। প্রতি সপ্তাহে পাইকারি দামে ১৪০০ টাকা কেজি হিসাবে ২০০ কেজি (মাসে ১ টন) চায়না পিতলের পাত নিয়ে আসা হয়। ১ কেজি পিতলের পাত থেকে ৩৮-৪০ জোড়া চুড়ি তৈরি হয়। প্রতিজোড়া চুড়ি তৈরিতে পিতলের পাত, কেমিকেল, কাঁচা ধুপ, সরিষার তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও শ্রমিকসহ খরচ পড়ে প্রায় ৬৫-৭০ টাকা। যা পাইকারি ১৭০-১৮০ টাকা মূল্যে বিক্রি করা হয়। খুচরা বিক্রি হয় ৩০০-৩৫০ টাকা জোড়া। এসব চুড়ি বগুড়া, নাটোর, রাজশাহী, ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।

শেখ কামালের কারখানায় ২০০ কেজি কাঁচামাল থেকে প্রায় ৫ হাজার জোড়া চুড়ি তৈরি হয়। যার পাইকারি মূল্য ৯ লাখ টাকা। সপ্তাহে ৫ হাজার জোড়া হিসাবে মাসে ২০ হাজার জোড়া চুড়ি তৈরি হয়। এ কারখানা থেকে প্রতিমাসে ৩৬ লাখ টাকার চুড়ি উৎপাদন হয়।

জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে এমন পাঁচটি কারখানা আছে। পাঁচটি কারখানা থেকে মাসে প্রায় ৫০ হাজার চুড়ি উৎপাদন হয়। পাইকারি দরে যার মূল্য প্রায় ১ কোটি টাকা।

এসব কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ২ হাজার শ্রমিকের। সাংসারিক কাজের পাশাপাশি কারখানায় কাজ করে বাড়তি আয় করছেন নারী শ্রমিকরা। কেউ কাজ করেন দিন চুক্তিতে আবার কেউ প্রতি জোড়া চুড়ি তৈরিতে। এতে প্রতিমাসে অন্তত ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা আয় করছেন তারা। পড়াশুনার পাশাপাশি এ কারখানায় কাজ করে বাড়তি আয় করছে শিক্ষার্থীরাও।


সোনার দাম বেশি হওয়ায় এ চুড়ির রুলি বালা চাহিদা বেড়েছে। ভারতেও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে ভারতে রপ্তানিতে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

চুড়িতে নকশা তৈরির কাজ করেন দপ্তরি পাড়ার কলেজ শিক্ষার্থী মুক্তি। তিনি বলেন, ‘নকশা তৈরির জন্য কারখানার মালিক আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। প্রতি জোড়ায় নকশা তৈরিতে মজুরি ১৫ টাকা। সে হিসেবে প্রতিদিন প্রায় ২০০-২৫০ টাকা আয় হয়। এ কাজ করে যা পাওয়া যায় তা দিয়ে নিজের ও পড়াশুনার খরচসহ সাংসারিক কাজেও সহযোগিতা করা যায়। অনেক শিক্ষার্থী বাড়িতে বসে এ কাজ করে বাড়তি টাকা আয় করছে।’

মহাদেবপুর  উপজেলার সদর কলেজ এলাকার গৃহবধূ কিরণ মালা বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে স্বামী অসুস্থ হয়ে মারা যান। তারপর সংসারে কষ্ট শুরু হয়। মানুষের বাড়িতে কাজ করতাম। ছেলেকে পড়াশুনা করানো কষ্টসাধ্য ছিল। পরে এ কারখানায় কাজ শুরু করি। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪-৫টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়।’

নওগাঁ শহরের দপ্তরি পাড়ার বাসিন্দা শেখ শিল্পালয় কারখানার মালিক শেখ কামাল বলেন, ‘বাবা-দাদা স্বর্ণের কারিগর ছিলেন। পৈত্রিক সূত্রে আমরা স্বর্ণের কারিগর। ব্যবসা মন্দা হওয়ায় ২০০৭ সালে পাড়ি জমাই দুবাইতে। এরপর আবারও ২০১২ সালে দেশে ফিরে কিছু করার ইচ্ছা ছিল।’

তিনি বলেন, ‘সোনার দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় চায়না পিতল থেকে শুরু করা হয় হাতের চুড়ি তৈরি। দেখতে সোনার মতো হওয়ায় কম দামের মধ্যে ক্রেতাদের কাছেও পছন্দের। শুরুতে একাই কাজটি করছিলাম। পিতল দিয়ে তৈরি করায় অনেকের কাছেই ছিল হাস্যকর। বর্তমানে কারখানায় কাজ করছেন ১৫০ জন শ্রমিক এবং মাঠে কাজ করছেন আরও প্রায় ৬০০ জন। যাদের অধিকাংশই নারী শ্রমিক।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভারতে এ চুড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে কিছু সমস্যার কারণে রপ্তানি করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। চুড়ির ওজন বেশি হওয়ায় খরচও বেশি হয়। আবার অনেকেই ভাবে এটা ভারত থেকে আমরা নিয়ে আসি। কিন্তু আমরা দেশে চুড়ি তৈরি করে ভারতে পাঠাই। আমার কাছে মনে হয়েছে এটি ব্যাপক সম্ভাবনাময় একটি শিল্প।’

আরেক কারখানার মালিক পাপ্পা হোসেন বলেন, ‘গত পাঁচ বছর থেকে রুলি বালা তৈরি করছি। ৫০ জন কারিগর কাজ করে আমার কারখানায়। এসব চুড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সোনা নাকি পিতলের চুড়ি সহজে কেউ বুঝতে পারবে না। সোনার দাম বৃদ্ধি হওয়ায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা এসব চুড়ি কিনছেন। সাধ্যের মধ্যে তাদের শখ পূরণ হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘ব্যবসার পরিধি আরও বাড়ানোর ইচ্ছা। কিন্তু বর্তমানে কাঁচামালের দাম কিছুটা বেড়েছে। চুড়ির দাম আগামীতে আরও বাড়তে পারে।’

এ বিষয়ে নওগাঁ বিসিক শিল্প নগরীর উপ-ব্যবস্থাপক শামীম আক্তার বলেন, ‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোগকে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। পণ্য প্রদর্শনীর জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মেলার আয়োজন করা হয়। এক্ষেত্রে কারিগরি প্রশিক্ষণসহ সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।’

এম এ রাজ্জাক/এমআই

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর