Logo

সারাদেশ

কেরানীগঞ্জের জমি যেন ‘পুঁথিগত বিদ্যা, পর হস্তে ধন’

নাগরিক জীবনে নতুন প্রকল্পের খড়্গ

Icon

নুর মোহাম্মদ মিঠু, ঢাকা ও মো. এরশাদ হোসেন, কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮:১৯

কেরানীগঞ্জের জমি যেন ‘পুঁথিগত বিদ্যা, পর হস্তে ধন’

হারিছ চৌধুরীর শিশু সন্তান ভূমিষ্ঠের পরই নবজাতকের হার্টে ধরা পড়ে তিনটি ছিদ্র। প্রতিটি ছিদ্রের আকার ৫ মিলিমিটারেরও বেশি। যে কারণে ঢাকার চিকিৎসকরা তাকে ভারতে নেওয়ার পরামর্শ দেন। বিয়ের ৭ বছর পর হওয়া প্রথম সন্তানের চিকিৎসায় কোনো ত্রুটি রাখতে চান না তিনি। তাই জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু ভূমি সার্ভার বন্ধের জটিলতায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন তিনি।

হারিছ চৌধুরী বলেন, ‘কেরানীগঞ্জে জমি বিকিকিনির অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে বন্ধ থাকা ভূমি সার্ভার। ভোগান্তির কথা চিন্তা করে ক্রেতারাও আপাতত জমি কিনতে চাইছেন না। করছেন না নগদ টাকার লেনদেনও।’

বেশকজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে হারিছ চৌধুরী আরও বলেন, ‘তারা জমি কিনতেই ঘুরছেন। কিন্তু অনলাইন ভূমিসেবা কার্যক্রম বন্ধে ভোগান্তির ভয়ে আপাতত লেনদেন করতে চাইছেন না। আমরাও এখন চোখে-মুখে দিশা পাচ্ছি না। সন্তানের জীবনমরণ প্রশ্নেও বাবা হিসেবে আজ আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়।’

কেবল হারিছ চৌধুরীই নন, জমি বিক্রি করে টাকা সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন কেরানীগঞ্জের অন্য বাসিন্দারাও। তেমনই একজন আজাদ হোসাইন। মেয়ের বিয়ের দিনক্ষণ নির্ধারণ হয়েছে। নগদ টাকার প্রয়োজনে জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ভাগ্যক্রমে সময়মতো জমির ক্রেতাও খুঁজে পান। কিন্তু বুঝে পাচ্ছেন না টাকা। ভূমি সেবার অনলাইন সার্ভার বন্ধ থাকায় জমির মালিকানা হস্তান্তরে পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন তিনি। জমি বুঝে না পাওয়ায় ক্রেতাও দিচ্ছেন না টাকা। এদিকে বিয়ের দিন কাছে চলে আসায় পড়েছেন বিপাকে। এখন বাধ্য হয়েই মেয়ের বিয়ে দিতে হচ্ছে ধারদেনার টাকায়।

গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরেই কেরানীগঞ্জ উপজেলায় এমন ভোগান্তিতে রয়েছেন ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির মালিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক প্রপার্টিজের মালিকরাও। এ নিয়ে ইউএনও, এসিল্যান্ড কিংবা জেলা প্রশাসক কার্যালয় হয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় পর্যন্ত যোগাযোগ করলেও কার্যত মিলছে না সমাধান। বরং মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা অনেকটা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছেন।

সারা দেশেই ভোগান্তির একই অবস্থা। নিজের সম্পদকে এখন ‘পুঁথিগত বিদ্যা, পর হস্তে ধন’- মনে করতে হচ্ছে মালিকদের। নাগরিক জীবনে নজিরবিহীন এমন জনভোগান্তির পাশাপাশি সরকারও হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। অথচ সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী এই ভোগান্তি হওয়ার কথা ছিল সাময়িক।

ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্পের আওতায় প্রস্তুতকৃত ভূমিসেবা সংশ্লিষ্ট মানোন্নীত (দ্বিতীয় সংস্করণ) চারটি সফটওয়্যার (মিউটেশন সিস্টেম, ভূমি উন্নয়ন কর সিস্টেম, ডিজিটাল রেকর্ড ও ম্যাপ ব্যবস্থাপনা সিস্টেম, ভূমি প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা সিস্টেম) এবং নব-সৃষ্ট একটি সফটওয়্যারের (ল্যান্ড সার্ভিস গেটওয়ে) দেশব্যাপী প্রচলন ও ব্যবহারের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নেয় ভূমি মন্ত্রণালয়।

এ কার্যক্রম শুরু আওতায় গেল বছরের ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ১ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত অনলাইনে প্রচলিত ও চালু তিনটি ভূমিসেবা (ই-মিউটেশন সিস্টেম, ই-পর্চা সিস্টেম ও ভূমি উন্নয়ন কর সিস্টেম) বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছিল ভূমি মন্ত্রণালয়। গত ১ ডিসেম্বর এ কার্যক্রম আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের কথা ছিল ভূমি উপদেষ্টার। অথচ বেঁধে দেওয়া সেই সময়ের দুই মাস পার হতে চলল। এর ফলে ভোগান্তির মাত্রা চরমে পৌঁছেছে। উল্লিখিত ভূমিসেবাগুলো অনেকটা অঘোষিতভাবেই বন্ধের পর্যায়ে।

দিনের পর দিন ঘুরেও ভূমি কর, জমি রেজিস্ট্রি বা নামজারি ভূমি সংক্রান্ত কোনো কাজই করতে পারছেন না কেরানীগঞ্জের কয়েক লাখ ভুক্তভোগী। ভূমি অফিসে ‘লেফট রাইট প্যারেড’ করেই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে তাদের। 

গত এক সপ্তাহ ধরে সরেজমিন অবস্থানকালে সেবাপ্রত্যাশীরা জানান, সরকার অনলাইন বা ডিজিটাল সেবা বন্ধ করুক, তাতে কোনো অভিযোগ নেই। তবে বিকল্প ব্যবস্থা না করে মাসের পর মাস ভূমিসেবা থেকে নাগরিকদের কেন বঞ্চিত করবে।

তারা বলছেন, কয়েকটি অফিসে সেবা চালু হলেও দেওয়া যাচ্ছে না হোল্ডিং ট্যাক্স। সেবা না পেয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গালমন্দও করতেও শোনা গেছে সেবাপ্রত্যাশীদের।

সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, ১২টি ইউনিয়ন, দুটি ভূমি অফিস (কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ ও কেরানীগঞ্জ মডেল), দুটি সাব-রেজিস্ট্রার, চারটি ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও ১২১টি মৌজা নিয়ে কেরানীগঞ্জ উপজেলা। এরমধ্যে কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ (ভূমি) রাজস্ব সার্কেলে ৫১টি মৌজা ও দুটি ইউনিয়ন ভূমি অফিস রয়েছে। দুটির মধ্যে কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ এসিল্যান্ডের আওতায় শুভাঢ্যা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের আইডি একমাস পর ফেরত পেলেও সমস্যার সমাধান হয়নি।

সেবা প্রত্যাশীরা এখনো বিভিন্ন সমস্যায় সম্মুখীন হচ্ছেন। আর এখনো বন্ধই রয়েছে কোন্ডা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের আইডি ও সার্ভার।

কেরানীগঞ্জ মডেল (ভূমি) রাজস্ব সার্কেল অফিসের সকল কার্যক্রম চালু রয়েছে বলে অফিস সূত্র দাবি করলেও সার্ভার সমস্যায় কোনো কাজই সঠিকভাবে হচ্ছে না বলে অভিযোগ সেবাপ্রত্যাশীদের।    

প্রযুক্তিগত জটিলতায় ই-নামজারি (মিউটেশন), ভূমি উন্নয়ন কর ও খতিয়ান সেবা পেতে এখনো সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে জানতে চাইলে কোন্ডা ইউনিয়ন তফসিলদার (ভূমি সহকারী) কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার ইউনিয়ন আইডি চালু না হওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না। আশা করি আগামী সপ্তাহে চালু হতে পারে।’

আর সার্ভার ত্রুটির বিষয়ে কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ রাজস্ব সার্কেল সহকারী কমিশনার কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি ভূমি মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে বলেন।

জানতে চাইলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ভূমি ব্যবস্থাপনা ও অটোমেশন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ইফতেখার হোসেন অনেকটা বিরক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘এসব কে বলে? ভূমিসেবা বন্ধ নেই। আপনি প্রকল্প অফিসে এসে খোঁজ নেন। তখন জানতে পারবেন।’

মিটিংয়ে আছেন বলে আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাইজেশন, নলেজ ম্যানেজমেন্ট ও পারফরমেন্স (ডিকেএমপি) অনুবিভাগের উপসচিব সেলিম আহমদ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘ভূমিসেবা বন্ধ নেই। চলমান রয়েছে। চালু করা হয়েছে। এখন কোথাও কোনো সমস্যা নেই।’

কেরানীগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনলাইন ভূমিসেবা কার্যক্রম এখনো বন্ধ রয়েছে জানালে তিনি বলেন, ‘কে বলেছে বন্ধ রয়েছে। ভূমিসেবা সারাদেশেই চালু আছে।’

উপজেলার ভূমিসেবার বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে কেরানীগঞ্জের নির্বাহী কর্মকর্তা রিনাত ফৌজিয়া বলেন, ‘দেশ ডিজিটাল হলেও ভূমি সেবা এখনো পুরোপুরি ডিজিটাল হয়নি।’

ভূমি উন্নয়ন কর কার্যসম্পাদনের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান সমস্যা

  • আর.এস মূল খতিয়ানের যে সকল জোত/হোল্ডিং এন্ট্রি ছিল নাগরিক খতিয়ানযুক্তের পরে সেসব জোত/হোল্ডিং সমন্বয় করা যাচ্ছে না।
  • ই-নামজারি থেকে খতিয়ান যুক্ত করে সমন্বয়ের পর নাগরিক আইডিতে হোল্ডিং তালিকায় যুক্ত হচ্ছে না।
  • যে সকল হোল্ডিং সমন্বয় করা ছিল সেই হোল্ডিং সংশোধন করলে সমন্বয় থেকে বাতিল হয়ে যাচ্ছে।
  • ই-নামজারি খতিয়ান ও হোল্ডিং নং একই হওয়ায় হোন্ডিংয়ের ধারাবাহিকতা থাকে না।
  • একই খতিয়ান কিন্তু জোত ভিন্ন, এন্ট্রি সমন্বয় নিচ্ছে না।
  • হোল্ডিং বাতিলের অপশনে বিভিন্ন কারণের সাথে অন্যান্য কারণ উল্লেখ না থাকায় সকল হোল্ডিং এর সমন্বয় সমাধান দেয়া যাচ্ছে না।
  • বেরিয়ার-৩ এ সর্বমোট আদায় মৌজাভিত্তিক এককভাবে দেখায়, যা পূর্বে ধারাবাহিকভাবে সকল মৌজাভিত্তিক একত্রে দেখা যেত।
  • সাধারণ ও সংস্থার হোল্ডিং সমন্বয়ের পর ভূমি মালিকের খতিয়ান সংযুক্তির অপশনে অনুমোদিত দেখালেও হোল্ডিং অপশনে দৃশ্যমান হয় না।
  • সমন্বয়ের সময় সরাসরি ২নং ধাপে চলে যায়, ফলে ১নং ও ৩নং ধাপ যাচাই করা যায় না।
  • একাধিক নামে নাগরিক কর্নার হতে সমন্বয়ের সময় হোল্ডিং এন্ট্রি দিলে শুধু একনাম দৃশ্যমান হয়।
  • রেজি: ২ হতে হিস্যা সংশোধনের পরেও পূর্বের ভুল হিস্যাই থেকে যাচ্ছে।
  • হোল্ডিংয়ের বিস্তারিত ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের বিবরণ দেখা যায় না।
  • হোল্ডিং এন্ট্রি থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সংস্থার ভূমি উন্নয়ন কর পূর্বের ন্যায় পরিশোধ করা যাচ্ছে না।
  • বেলা ১১টার পরে সার্ভারে এরোর কোড  (Error Code) দৃশ্যমান হয়।
  • মোবাইল নম্বর সংশোধন নাগরিক নিবন্ধন আইডি বা অফিস আইডি- কোনোটাতেই সংশোধন বা পরিবর্তন করা যাচ্ছে না।

ইমিউটেশনের কার্যসম্পাদনের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান সমস্যা

  • কোনো কোম্পানির নামে আবেদন করা যায় না।
  • আবেদন করার সময় বাই হোল্ডিং নং থাকলে তা কর্তনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় না। যেমন- হোল্ডিং নং ২২/১২ এ ধরনের।
  • কেরাণীগঞ্জ দক্ষিণের সকল মৌজা পাওয়া যায় না।
  • খতিয়ানের মালিকানার সঠিক হিস্যা দেওয়ার পরও হিস্যা সংরক্ষণ হয় না। একাধিকবার ‘আবার চেষ্টা করুন’ অপশন দৃশ্যমান হয়।
  • দলিলের প্রকৃতি ও বর্ণনা সয়ংক্রিয়ভাবে পূরণ করা থাকা স্বত্বেও আবার লিখতে হয়।
  • প্রভাবপত্রও খসড়া খতিয়ান সংরক্ষণ করে রাখা হলে পরবর্তীতে পুনরায় আবার তথ্য সরবরাহ করে সংরক্ষণ করতে হয়।
  • প্রতিবেদন লেখার ক্ষেত্রেও প্রশ্নোত্তর পর্ব দৃশামান থাকে।

এমএইচএস/এইচকে/ওএফ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর