ইউরোপের প্রলোভন দেখিয়ে মিয়ানমারে বন্দি, কয়েক ধাপে নির্যাতন

কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৯:৩৭

গাজীপুরের কালীগঞ্জে আরিফ হোসেনকে (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে ইতালিতে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মিয়ানমারে নিয়ে বন্দি করে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে মানবপাচার চক্রের বিরুদ্ধে। পরে বন্দি আরিফের উপর কয়েক ধাপে নির্যাতন চালিয়ে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করা হয়েছে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় অভিযোগের পর জড়িত এক রোহিঙ্গাসহ মানবপাচার চক্রের ৪ সদস্যকে কক্সবাজার থেকে গ্রেপ্তার করেছে কালীগঞ্জ থানা পুলিশ। তবে বন্দি আরিফকে উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে পুলিশ।
শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আলাউদ্দিন। এর আগে দুপুরে গ্রেপ্তারকৃত চারজনকে গাজীপুর আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।
গ্রেপ্তার আসামিরা হলেন কক্সবাজারের মোস্তাক আহমেদ (৫৪), বোরহান (২১), টেকনাফের তৈয়ব (২১) ও উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা মিয়ানমারের বাসিন্দা মো. উল্লাহ (৩৮)। অন্যদিকে, মিয়ানমারে বন্দি আরিফ হোসেন কালীগঞ্জ উপজেলার তুমলিয়া ইউনিয়নের চুয়ারিয়াখোলা গ্রামের জয়নাল আবেদিনের ছেলে।
ওসি বলেন, চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় এক রোহিঙ্গাসহ আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শনিবার তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার আসামিরা জানিয়েছেন, ভিকটিম আরিফ বর্তমানে মিয়ানমারে আছেন। তাকে উদ্ধারে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান পুলিশের ওই কর্মকর্তা।
বন্দির স্বজনরা জানায়, আরিফ হোসেন দুই বছর আগে মালয়েশিয়ায় কর্মরত থাকা অবস্থায় এক আত্মীয়ের মাধ্যমে তার পরিচয় হয় কক্সবাজারের রামুর পশ্চিম সিকদার পাড়ার কামাল উদ্দিনের ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুন ও পূর্ব কলাতলির মীর কাশেমের ছেলে মোস্তাক আহমেদসহ অজ্ঞাত ৩-৪ জনের সঙ্গে। ওই সময় তারা বিদেশে লোক পাঠানোর ব্যবসা করে বলে জানায়। ২০২৩ সালে মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরে আসেন আরিফ হোসেন। এরপর তাকে ইতালি পাঠানোর প্রলোভন দেখায় মামুন ও মোস্তাক। একপর্যায়ে ৬ লাখ টাকায় ইতালি যাওয়ার জন্য ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তাদের সঙ্গে চুক্তি করেন তিনি। এরপর ১১ ডিসেম্বর আবদুল্লাহ আল মামুনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এক লাখ ও ১৭ ডিসেম্বর আরও এক লাখ টাকা পাঠানো হয়। পরে নগদে আরও তিন লাখ টাকা দেওয়া হয়।
সূত্র আরো জানায়, তারা আরিফকে প্রথমে মিয়ানমারে নিয়ে পরে ইতালি পাঠানোর কথা বলে ১১ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। মিয়ানমারে নেওয়ার পর তারা আরিফকে বন্দি করে নির্যাতন করতে থাকে। পরবর্তীতে অপহরণকারীরা অজ্ঞাত মোবাইল নম্বর থেকে ফোন দিয়ে আরিফের মাধ্যমেই তার পরিবারকে জানায় যে, এক লাখ টাকা পাঠালে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। পরে ১ জানুয়ারি মামুনের ইসলামী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে এক লাখ টাকা পাঠানো হয়। কিন্তু তারা আরিফকে মুক্তি দেয়নি।
পরিবারের দাবি, চক্রের সদস্যরা আরো ৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। টাকা না দিলে আরিফকে হত্যার হুমকি দেয় তারা। পরে ৫ জানুয়ারি তাদের দেওয়া একাধিক বিকাশ নম্বরে ৪ লাখ টাকা পাঠানো হয়। কিন্তু টাকা পাওয়ার পর অভিযুক্তরা তাদের সব মোবাইল ফোন বন্ধ করে রাখে। একপর্যায়ে ১৮ জানুয়ারি আরিফের স্ত্রী সুলতানা বেগম এসব বিষয় উল্লেখ করে প্রথমে কালীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পরে ২৬ জানুয়ারি মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২ এর ৭/৮/১০ (১) ধারায় প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে নিয়ে আটক করে মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে কালীগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন তিনি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কালীগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. রাসেল বলেন, এ ঘটনায় জড়িতরা আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় প্রথমে মোস্তাককে কক্সবাজারে অভিযান চালিয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাতে অভিযান চালিয়ে মানব পাচারকারী চক্রের আরও তিন সদস্যকে কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
রফিক সরকার/ওএফ