Logo

সারাদেশ

ফের অশান্ত ঝিনাইদহ, চরমপন্থী হানিফ নিয়ে যা জানা গেল

Icon

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩:৩৩

ফের অশান্ত ঝিনাইদহ, চরমপন্থী হানিফ নিয়ে যা জানা গেল

আবার অশান্ত হয়ে উঠছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক সময়কার চরমপন্থী অধ্যুষিত জেলা ঝিনাইদহ। গত প্রায় দেড় দশক আগে ফাইভ মার্ডারের পর আবার ট্রিপল মার্ডারের ঘটনা ঘটল একই স্থানে।

শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাত ১১টার দিকে শৈলকুপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের শ্মশান ঘাট এলাকায় শীর্ষ তিন চরমপন্থী সন্ত্রাসীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় নিহতদের পরিচয় শনাক্ত করেছে পুলিশ। 

তারা হলেন- ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আহাদনগর গ্রামের রাহাজ উদ্দীনের ছেলে হানেফ আলী (৫৬), তার শ্যালক শ্রীরামপুর গ্রামের উমেদ আলীর ছেলে লিটন (৩৫)  ও কুষ্টিয়ার দৌলতপুর এলাকার আরজেদ আলীর ছেলে রাইসুল ইসলাম রাজু (২৫)। এদের মধ্যে হানেফ আলী নিষিদ্ধ চরমপন্থী সংগঠন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) আঞ্চলিক কমান্ডার। নিহত চরমপন্থী নেতা হানিফের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ১৩টি হত্যাসহ বিভিন্ন মামলা রয়েছে। 

উল্লেখ্য, ২০১১ সালে একই স্থানে পাঁচজনকে হত্যা করে চরমপন্থীরা। এদিকে রাতেই এই হত্যার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে নিষিদ্ধ আরেক চরমপন্থী সংগঠন জাসদ গণবাহিনী। নিহতদের মরদেহ শৈলকুপা থানায় রাখার খবর জানতে পেরে শনিবার ভোর থেকে শতশত মানুষ ভিড় করছে থানায়। চাঞ্চল্যকর এই ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। নিহতের স্বজনদের দেখা যায়নি মরদেহগুলোর কাছে।  চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ এখনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি তবে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হবে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

তিনজনকে হত্যার দায় স্বীকার করে জাসদ গণবাহিনীর কালু পরিচয় দিয়ে ঝিনাইদহের স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে শুক্রবার রাতে যে মেসেজ পাঠানো হয়েছে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, হয় ‘এতদ্বারা ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনাবাসীর উদ্দেশ্যে জানানো যাইতেছে যে, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী কুখ্যাত ডাকাত বাহিনীর শীর্ষ নেতা অসংখ্য খুন, গুম, দখলদারি, ডাকাতি, ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হরিনাকুন্ডু নিবাসী মো. হানিফ তার দুই সহযোগীসহ জাসদ গণবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছেন। তাদের লাশ রামচন্দ্রপুর ও পিয়ারপুর ক্যানালের পাশে রাখা আছে। অত্র অঞ্চলের হানিফের সহযোগীদের শুধরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হলো অন্যথায় আপনাদের একই পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে। কালু জাসদ গণবাহিনী।’ তবে ক্ষুদেবার্তাটির প্রেরক সত্যিকারের কালু কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হচ্ছে বলেও জানানো হয়েছে।

রামচন্দ্রপুর এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম জানান, রাতে ৮টার পরে তারা মাঠের দিকে বেশ কয়েকটি গুলির শব্দ শুনতে পান। তবে ভয়ে আর কেউ ঘর থেকে বের হননি। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিছু সময় পর রাত সাড়ে ১১টার দিকে এলাকাবাসী একত্রিত হয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনটি মরদেহ ও দুইটি মোটরসাইকেল পড়ে থাকতে দেখেন। এরপর তারা পুলিশে খবর দেন।

পুলিশ ও এলাকাবাসী জানায়, দীর্ঘদিন ধরে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) ও জাসদ গণবাহিনী নামে দুই চরমপন্থী দলের মধ্যে বিরোধ চলছিল। শুক্রবার রাতে রামচন্দ্রপুর শ্মশানঘাট এলাকায় পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের গোপন বৈঠকের খবর পেয়ে যায় প্রতিপক্ষরা। জাসদ গণবাহিনীর শীর্ষ নেতা কালুর নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করছেন পুলিশ ও স্থানীয়রা।

যে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তারা সবাই চরমপন্থী দলের এক সময়ের নেতা কর্মী। এদের মধ্যে হানেফ আলী একটি মামলায় মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামি ছিলেন। অপর দুইজনের একজন হানেফ আলীর শ্যালক লিটন হোসেন ও অপরজন হানেফ আলীর আরেক সহযোগী রাইসুল ইসলাম রাজু। শুক্রবার রাতে শৈলকুপা উপজেলার ত্রিবেনী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর শ্মশানঘাট এলাকায় প্রতিপক্ষ গুলি চালিয়ে হত্যা করে তাদের ফেলে রেখে যায়। রাতেই ঘটনাস্থল থেকে নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তাদের সবার মাথায় গুলির চিহ্ন রয়েছে।

শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুম খান বলেন, ‘সোর্সের মাধ্যমে খবর পাই, গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এরপর নিশ্চিত হওয়া যায় ঘটনাস্থলে তিনজনের মরদেহ পড়ে আছে। লাশ উদ্ধার করে রাতেই থানায় আনা হয়েছে।’

কে এই হানিফ
৫৫ বছর বয়সী হানিফ আলীর বাড়ি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আহাদনগর গ্রামে। তিনি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শীর্ষ চরমপন্থী সংগঠন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি জনযুদ্ধের (লাল পতাকা) আঞ্চলিক কমান্ডার। ৯০ এর দশকে হত্যা ও ডাকাতির মাধ্যমে এলাকায় অপরাধজগতে একক আধিপত্য বিস্তার করেন। তার নামে হরিণাকুণ্ডু, ঝিনাইদহ সদর, চুয়াডাঙ্গা, আলমডাঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় ১৪টি হত্যা, অপহরণ ও ডাকাতির মামলা আছে।

গত ৭-৮ বছর ধরে হরিণাকুণ্ডর নারায়নকান্দি কায়েতপাড়া বাওড় দখল করে মাছ চাষ করে আসছিলেন। ২০১৪ সালে জেল থেকে বের হয় হানিফ। পরে ২০১৮ সালে ওই বাওড়ের মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি জিয়াউর রহমান জিয়াকে গলাকেটে হত্যা করে বাঁওড়ের দখল নেয় হানিফ। সম্প্রতি বাওড় দখলকে কেন্দ্র করে এলাকার কয়েকটি নিষিদ্ধ চরমপন্থি সংগঠনের মধ্যে বিরোধ চলছিল। এ কারণেই প্রতিপক্ষ জাসদ গণবাহিনী তাকে হত্যা করেছে বলে ধারণা এলাকাবাসীর। 

এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে, উপজেলার কুলবাড়িয়া গ্রামের আব্দুর রহমান নামে এক ব্যক্তিকে গলাকেটে হত্যার পর তার মাথা নিয়ে ফুটবল খেলেছিল এই হানেফ। এই হত্যা মামলার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। পরে  

চরমপন্থী হানিফের এক ভাই হরিণাকুণ্ডু উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও আরেক ভাই উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা সেচ্ছাসেবক লীগের বর্তমান সহ-সভাপতি। হানিফ নিজে হরিণাকুণ্ডু উপজেলা মৎস্যজীবীলীগের সিনিয়র সহসভাপতি  ছিলেন ।

হানিফের ভাই সাজেদুল ইসলাম ইশা বলেন, ‘গতকাল (শুক্রবার) বিকেলে হানিফের মোবাইল ফোনে একটি কল আসে। এরপর ভাই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। সন্ধ্যা থেকে তার মোবাইল ফোনে কল দিলেও ধরেননি। পরে রাতে তার মৃতদেহ পাই।’

ভাগনে নিহতের খবর পেয়ে শৈলকুপা থানায় আসা রাইসুল ইসলামের মামা মোহাম্মদ মিল্টন বলেন, ‘লেখাপড়া শেষ করে রাইসুল চাকরি নেওয়ার চেষ্টা করছিল। কুষ্টিয়ার এক সংসদ সদস্যের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তবে ঠিক কী কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে, তা জানতে পারিনি।’

মোহাম্মদ মিল্টন আরও বলেন, ‘রাইসুল পিয়ারপুর এলাকার নানাবাড়ি থেকে শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে বের হয়ে যায়। সন্ধ্যা থেকে তার মোবাইল ফোনে কল দিয়ে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে রাতে জানতে পেলাম, রাইসুল গুলিতে নিহত হয়েছে।’

জানা গেছে, একই স্থানে ২০০৩ সালের ৫ ডিসেম্বর শৈলকুপা উপজেলার শেখপাড়া গ্রামের শহীদ খা, ত্রিবেনী গ্রামের শাহনেওয়াজ, একই গ্রামের ফারুক, নুরু কানা ও কুষ্টিয়ার ভবানীপুর গ্রামের কটাকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

এই মামলায় ২০২৪ সালের ২৯ অক্টোবর ঝিনাইদহ জেলা জজ আদালতে কুষ্টিয়ার আলী রেজা ওরফে কালু ও জেলার পিয়ারপুর গ্রামের মহসিন আলীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এই অঞ্চলে এক সময় ‘শ্রেণিশত্রু খতম’ করার নামে চরমপন্থি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি জনযুদ্ধ, লাল পতাকা, জাসদ, এমএল, কমিউনিস্ট পার্টির হক গ্রুপ ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে একে অন্যকে হত্যা করত। হত্যার পর দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিতেন চরমপন্থিরা।

  • এম বুরহান উদ্দীন/ওএফ
Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর