Logo

সারাদেশ

ঝিনাইদহে ‘ট্রিপল মার্ডার’ ঘিরে নানামুখী রহস্য, জনমনে আতঙ্ক

Icon

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩:৪১

ঝিনাইদহে ‘ট্রিপল মার্ডার’ ঘিরে নানামুখী রহস্য, জনমনে আতঙ্ক

ট্রিপল মার্ডারের লাশ দেখতে থানায় জনতার ভীড় /ছবি : বাংলাদেশের খবর

ঝিনাইদহের শৈলকুপায় গুলিতে চরমপন্থী নেতাসহ চাঞ্চল্যকর ট্রিপল মার্ডার ঘিরে নানামুখী রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। এতে জনমনে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। 

শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) রাতে নিহতদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এ ঘটনার দুদিন পার হলেও মামলা হয়নি (২৩ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা পর্যন্ত), আর কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়নি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো অভিযানের খবরও পাওয়া যায়নি। তবে হত্যাকাণ্ডের ক্লু উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কাজ করে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।

হত্যার পরপর রাতেই দায় স্বীকার করে চরমপন্থী সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর নেতা কালু পরিচয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে মেসেজ পাঠানো হয়। যদিও এ বার্তা নিয়ে পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। চরমপন্থী গ্রুপগুলোর দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে ক্ষুদেবার্তায় দায় স্বীকারের ঘটনা ঘটতে পারে। এছাড়া বাঁওড়, বিল ও জলমহাল দখল, টেন্ডার নিয়ে কেন্দ্রীয় বিরোধ ও সাম্প্রতিক টানাপোড়েন এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে থাকতে পারে বলে ধারণা পুলিশের।

গত শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাতে শৈলকুপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর শ্মশানঘাট এলাকায় গুলি করে ৩ জনকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহতরা হলেন- হরিণাকুন্ডু উপজেলার আহাদনগর গ্রামের হানিফ (৫২), তার শ্যালক উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের লিটন (৩৭) ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলার রাইসুল ইসলাম (২৭)।

নিহতদের মধ্যে হানিফ পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) আঞ্চলিক নেতা এবং একাধিক হত্যা ও ডাকাতি মামলার আসামি ছিলেন। একটি হত্যা মামলায় তিনি ফাঁসির দণ্ড থেকে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা পেয়ে মুক্তি লাভ করেন। পরে তিনি হরিণাকুণ্ডু উপজেলা মৎস্যজীবী লীগের পদ পান। প্রভাব খাটিয়ে দখল-বাণিজ্য শুরু করেন। গত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে।

স্থানীয়রা জানান, হানিফ ৯০ দশকে চরমপন্থী দলের সঙ্গে যুক্ত হন। জনযুদ্ধের (লাল পতাকা) আঞ্চলিক নেতা হিসেবে ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ার কিছু অংশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। চলার পথে কোনো বাধা রাখতেন না। একে একে ১৪টি হত্যা মামলায় আসামি হন। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, বোমা হামলার মামলা হয়। ১৯৯৯ সালে হানিফ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। হত্যা মামলায় তার ফাঁসির আদেশ হয়। পরে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমায় তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। হানিফের ছোট ভাই সাজেদুল ইসলাম এশা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভোট করলে হানিফ গোটা এলাকায় প্রভাব বিস্তারে কাজ করেন। তার পুরোনো সহকর্মীদের নিয়ে গণসংযোগ করতেন। এতে ভোটারদের মধ্যে একধরনের ভীতি তৈরি হয়।

হানিফের ভাই সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সাজেদুল দাবি করেন, তার ভাই রাজনৈতিক কারণে একাধিক মামলার আসামি হয়েছিলেন। সব মামলায় তিনি খালাস পান। একটি মামলায় সাধারণ ক্ষমায় মুক্ত হন। ছাড়া পেয়ে ছয় বছর ঢাকায় ছিলেন। এলাকায় এলে অনেকে অনেক কথা বলতে পারেন, এই ভেবে ঢাকায় থাকতেন। গত তিন বছর হলো এলাকায় বাস করতেন। তিনি কোনো খারাপ কাজের সঙ্গে ছিলেন না। সরকারের কাছ থেকে বাঁওড় বন্দোবস্ত নিয়ে মাছের চাষ করতেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দক্ষিণ-পশ্চিমের এক সময়ের রক্তাক্ত জনপদ খ্যাত ঝিনাইদহে আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে চরমপন্থী দলগুলো। একসময় জাসদ গণবাহিনী, বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি ও সর্বহারা পার্টির মতো নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থীদলের আধিপত্য ছিল তুঙ্গে।

দীর্ঘদিন ধরেই এসব চরমপন্থী দলগুলোর আধিপত্য দেখা যায়নি। হঠাৎ করেই এক চরমপন্থী নেতাসহ তিনজনকে হত্যার পর আরেক চরমপন্থী সংগঠন পরিচয়ে গণমাধ্যমে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো, তাদের উত্থানের বার্তা বলে মনে করছেন অনেকে।

বিগত দশকগুলোতে হত্যার আগে ও পরে এসব নিষিদ্ধ চরমপন্থী দলের পক্ষ থেকে দেয়া হতো চিরকুট বা মোবাইল কল। তেমনিই ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে গত ২১ ফেব্রুয়ারি শৈলকুপার রামচন্দ্রপুর গ্রামের শ্মশান ঘাট এলাকায়। হত্যার দায় স্বীকার করে আরেক চরমপন্থী সংগঠন জাসদ গণবাহিনী পরিচয়ে আগের মতো গণমাধ্যম কর্মীদের হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েছে। চরমপন্থীদের এই উত্থানে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে আতঙ্ক। তাহলে কী চরমপন্থীরা আবারো মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে এমন গুঞ্জন জেলাজুড়েই।

মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার ঝিনাইদহ জেলা সভাপতি আমিনুর রহমান টুকু জানান, ৯০ দশকের দিকে ঝিনাইদহ জেলায় নিষিদ্ধ চরমপন্থী দলগুলোর ব্যাপক দৌরাত্ম্য ছিল। প্রতিদিনই খুনের খবর শুনে মানুষের ঘুম ভাঙতো। মাথা কেটে পরিবারের লোকজনের সামনেই ফুটবলের মতো খেলত এসব সন্ত্রাসীরা। পুলিশও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। মানবাধিকার লঙ্ঘন চরম পর্যায়ের পৌঁছে যায়।

তিনি আরও জানান, এসব ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্য এ অঞ্চলে পুলিশ ক্যাম্প বৃদ্ধি করা হয়। প্রশাসনের তৎপরতায় এক পর্যায়ে চরমপন্থী দল নির্মূল হয়ে যায়। দীর্ঘদিন চরমপন্থী দলের কোনো তৎপরতা ছিল না। হঠাৎ শৈলকুপায় তিন খুনের মধ্যদিয়ে তাদের উপস্থিতি জানান দিল।

আমিনুর রহমান টুকু জানান, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে চরমপন্থী তৎপরতা খুবই দুঃখজনক। চরমপন্থী দমনে তিনি প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুম খান বলেন, যেহেতু ঘটনাটি শৈলকুপা ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় সংঘটিত হয়েছে, সেহেতু কুষ্টিয়ার ইবি থানা ও শৈলকূপা থানা পুলিশ যৌথভাবে এ ঘটনার তদন্ত করবে। মামলা দায়ের হয়নি। নিহত হানিফের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। তারা রোববার বিকেল নাগাদ থানায় মামলা করার জন্য আসতে পারেন। আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি।

হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাসদ গণবাহিনীর দায় স্বীকার প্রসঙ্গে ওসি মাসুম খান বলেন, হোয়াটসঅ্যাপ বা মোবাইল ফোনে নামে বেনামে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে দায় স্বীকারের বিষয়টি চূড়ান্ত কোনো প্রমাণ নয়। আমরা এটিকে কেবল একটি উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমরা পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখব।

তিনি বলেন, অতীতেও এরকম দায় স্বীকারের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তদন্তে গিয়ে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। অনেক সময় অপরাধীরা ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য এরকম কৌশল ব্যবহার করে। আমরা সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করে তদন্ত ও অনুসন্ধান করব। মামলা হওয়ার পরই গ্রেপ্তার অভিযান শুরু করব।

ওসি মাসুম খান আরও বলেন, আমরা জানতে পেরেছি যে বাঁওড় ও বিলের জলমহাল নিয়ে নিহত হানিফের সঙ্গে কয়েকজনের বিরোধ চলছিল। এসব তথ্য স্থানীয় সাধারণ মানুষও জানে। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার নাকি চরমপন্থী যোগসাজশ রয়েছে, তা এখনই নিশ্চিত নই। তবে আমরা তদন্তের সময় সব বিষয় বিবেচনায় রাখব।

ঝিনাইদহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান জাকারিয়া জানান, ট্রিপল মার্ডারের পর থেকে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ব্যাপক তৎপর রয়েছে। পুলিশের কাছে নানান ধরনের তথ্য আসছে। সেগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে। জাসদ গণবাহিনী নামে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে এ হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন দিকে নেয়ার অপচেষ্টা কিনা সেটাও দেখা  হচ্ছে।

এ ছাড়া হরিণাকুণ্ডুর কায়েতপাড়া বাঁওড় নিয়ে বিবাদমান দুই চরমপন্থীদলের মধ্যে এই খুনাখুনি কিনা তাও দেখা হচ্ছে। দ্রুত এই ট্রিপল মার্ডারের ক্লু উদ্ধার করতে আমরা সক্ষম হব। অপরাধীরা পার পাবে না।

এদিকে নিহত তিনজনের ময়নাতদন্ত শেষে শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে পরিবারের কাছে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়। পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক কমান্ডার হানিফকে হরিণাকুণ্ডুর আহাদনগর গ্রামে নামাজে জানাজা শেষে রাত ১১টার দিকে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয় ও তার শ্যালক লিটনকে শ্রীরামপুর গ্রামে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়। এ ছাড়া রাইসুল ইসলামকে রাত ৯টার দিকে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পিয়ারপুর গ্রামে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ঝিনাইদহের শৈলকুপা ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী হওয়ায় রামচন্দ্রপুর মাঠ দুর্গম এলাকা হিসেবে পরিচিত। এর আগেও একই স্থানে ২০০৩ সালে চাঞ্চল্যকর ফাইভ মার্ডারের মতো ঘটনা ঘটেছে। তারা হলেন- শৈলকুপা উপজেলার শেখপাড়া গ্রামের শহীদ খা, ত্রিবেনী গ্রামের শাহনেওয়াজ, একই গ্রামের ফারুক, নুরু কানা ও কুষ্টিয়ার ভবানীপুর গ্রামের কটাকে গুলি ও গলাকেটে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

এই মামলায় ২০২৪ সালের ২৯ অক্টোবর ঝিনাইদহ জেলা জজ আদালতে কুষ্টিয়ার আলী রেজা ওরফে কালু ও জেলার পিয়ারপুর গ্রামের মহসিন আলীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এই অঞ্চলে এক সময় ‘শ্রেণিশত্রু খতম’ করার নামে চরমপন্থী পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি জনযুদ্ধ, লাল পতাকা, জাসদ, এমএল, কমিউনিস্ট পার্টির হক গ্রুপ ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে একে অন্যকে হত্যা করত। ওই হত্যার পর দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছিলেন চরমপন্থীরা।

  • এম বুরহান উদ্দীন/ওএফ
Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর