Logo

সারাদেশ

স্বামী নিরু‌দ্দেশ, দখল হয়ে গেল জোছনা অধিকারীর ভিটাবাড়ি

Icon

খুলনা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:১২

স্বামী নিরু‌দ্দেশ, দখল হয়ে গেল জোছনা অধিকারীর ভিটাবাড়ি

জোছনা অধিকারী, তার দুই শিশু ও শাশুড়ি।

জোছনা অধিকারী (৩৫) সাতক্ষীরা সদ‌রের একটি দ‌রিদ্র প‌রিবা‌রের মে‌য়ে। ১৬ বছর পূ‌র্বে খুলনার কয়রার এক‌টি নিম্নমধ্যবিত্ত প‌রিবা‌রে বি‌য়ে হয় তার। স্থানীয় এক‌টি বাজা‌রে স্বামীর কাপ‌ড়ের দোকান ছিল। আধাপাকা বাড়িতে স্বামী, বৃদ্ধা শাশুড়ি ও তিন সন্তান নিয়ে সুখের সংসার ছিল তার। তিন সন্তানকে ঘি‌রে ছিল বড় স্বপ্ন। যত কষ্টই হোক তা‌দের‌কে মানুষের মতো মানুষ করবেন। 

কিন্তু হঠাৎ তার স্বপ্ন ভে‌ঙে তছনছ হ‌য়ে যায়। স্বামী-‌ভি‌টেবা‌ড়ি হা‌রি‌য়ে প‌রিবার নি‌য়ে এখন নিঃস্ব। এক‌টি মুস‌লিম প‌রিবা‌রে সাম‌য়িক ঠাঁই মি‌ল‌লেও তিন সন্তান এবং বৃদ্ধা শাশু‌ড়ি‌কে নি‌য়ে খে‌য়ে না খে‌য়ে ক‌ষ্টে দিন‌তিপাত কর‌তে হ‌চ্ছে।

জোছনা অধিকারীর স্বামী অশোক অধিকারী দ্বিতীয় বিয়ে করে নিরুদ্দেশ। যা‌কে দ্বিতীয় বি‌য়ে ক‌রে‌ছেন তার প‌রিবা‌র মামলা দেয়। ওই মামলায় জোছনা অধিকারী জেল খে‌টে‌ছেন। এর আগে গোপনে বসতভিটা ও ফসলি জমির বেশিরভাগ অংশ একজন প্রবাসীর কা‌ছে বিক্রি করে দেন স্বামী। বসতবাড়ির ১৭ শতাংশ জমি অবিক্রীত থাক‌লেও প্রভাব খা‌টি‌য়ে সম্পূর্ণ অংশ জবর দখল করার পাঁয়তারা ক‌রে ওই প্রবাসী প‌রিবার। ত‌বে স্থানীয়‌দের বাধার মু‌খে ও জনপ্রতি‌নি‌ধি‌দের সহ‌যো‌গিতায় জোছনাদের উচ্ছে‌দে ব‌্যর্থ হয়। ত‌বে গত ৫ আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির সুযোগে সেই গোপন ক্রেতা লোকজন দিয়ে দখলে নিয়েছেন সবকিছুই। তখন থেকে তিন সন্তান আর বৃদ্ধা শাশুড়িকে নিয়ে অন্যের ঘরের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছেন জোছনা। খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের শেখ-সরদারপাড়া গ্রামে এই পরিবারের বসবাস।

সম্প্রতি স‌রেজ‌মিন যে‌য়ে দেখা যায়, আশ্রয়দাতার ঘরের বারান্দায় বসে রান্নার জন‌্য তরকা‌রি কাট‌ছেন জোছনা। পা‌শে ছোট মেয়ে দিশা (৩) ও মেজ মেয়ে অঙ্কিতা (৫)। ওই সময় এ প্রতি‌বেদক‌কে তার দুঃখগাথা জানান। তি‌নি কান্নাজ‌ড়িত ক‌ন্ঠে বলেন, ‘অনেক ভা‌লো‌ ছিলাম। কীভা‌বে কী হ‌য়ে গেল বুঝ‌ছি না। স্বামী‌কে হারা‌নোর প‌রেও তিন সন্তা‌ন ও শাশু‌ড়ি‌কে নি‌য়ে নি‌জে‌দের ঘ‌রে থাক‌‌ছিলাম। লো‌কের বা‌ড়ি কাজ ক‌রে সংসার চালা‌চ্ছিলাম। এখন বা‌ড়ি থে‌কে বের ক‌রে আমা‌দের প‌থে না‌মি‌য়ে দি‌য়ে‌ছে।’

প্রশাসনকে বলেও সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ জোছনার। তিনি বলেন, ‘থানার পু‌লিশসহ অনেককে ব‌লে‌ছি। কোনো ব‌্যবস্থা হয়‌নি। ‌ছে‌লের লেখাপড়ার খরচ মেটা‌তে পার‌ছি না, খে‌য়ে না খে‌য়ে দিন যা‌চ্ছে। সন্তানগুলোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এইভাবে বেঁচে থাকা যে কত কষ্টের, তা আমার মতন আর কেউ বুঝবে না।’

তি‌নি আরও ব‌লেন, ‘জমিটি যে কিনেছে, সে বিদেশে থাকে। তার টাকার জোর আছে। তার পক্ষ নিয়ে হঠাৎ একদিন ২০-২৫ জন অপরিচিত মানুষ এসে আমাদের ঘর থেকে বাইরে বের করে দেয়। আমাদের পরনে যা ছিল, তাই নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। বি‌ক্রির প‌রেও ১৭ শতক জ‌মি আছে। এরপ‌রেও সব কে‌ড়ে নিয়েছে। পু‌লিশ, স্থানীয় অনেককে জানিয়েছি। কেউ তো সঠিক বিচার করে না। তাই ভগবানের কাছে বিচার দিয়েছি।’

তার সা‌থে কথা বলার মা‌ঝে ওইখানে এসে বসেন তার শাশু‌ড়ি বৃদ্ধা মায়া অধিকারী (৬৫)। চার মে‌য়ে ও এক ছে‌লে তার। তি‌নি স্বামীহারা হন অনেক আগেই। ছে‌লে‌কে হা‌রিয়ে তি‌নি দি‌শাহারা। কাঁপা গলায় তি‌নি ব‌লেন, ‘ছোট্ট বিলায় ওর (ছে‌লে) বাবা মারা যায়। কষ্ট ক‌রে বড় ক‌রে‌ছি। নি‌জে বি‌য়ে ক‌রেছে, ওর চার বোন‌কে বি‌য়ে দি‌য়ে‌ছে। তহন এক কাঠা জ‌মিও বে‌চে‌নি। কি হুইছে বুঝি‌নি, শু‌নে‌ছি জ‌মি বি‌চি গে‌ছে। আমাগেরে পথে বসিয়ে পালাইছে।’

আশ্রয়দাতা মাছুরা বলেন, ‘আমারও স্বামী নেই। স্বামী ফেলে গেলে কী অসহায় অবস্থা হয়, তা আমি জানি। তাই অসহায় পরিবারটিকে আশ্রয় দিছি। কিন্তু কত দিন পারব, বলতি পারিনে। তাদের নিয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্যদের কাছে গেছি। এমনকি কয়েকবার পুলিশের কাছেও ধরনা দিছি। কিন্তু কেউ কোনো সমাধান দিল না।’

উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে কয়েক দফা সালিশ হয়েছিল। সেখানে দেখা গেছে, জোছনা স্বামী অশোক অধিকারীর ৬৬ শতাংশ জমির মধ্যে মালয়েশিয়া প্রবাসী গোলাম রসুল ৪৯ শতাংশ জমি কিনে নিয়েছেন। বাকি জমি এখনো অবিক্রিত আছে। যে কারণে তাদের বসতবাড়িটি রক্ষার জন্য চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সব জমি দখলে নিয়ে পরিবারটিকে ভিটাছাড়া করা হয়েছে। আমার সা‌ধ্যের বাইরে চ‌লে গে‌ছে।’

সরেজমিনে জোছনা অধিকারীর পুরোনো বসতভিটায় গিয়ে দেখা গেছে, আধাপাকা ঘরের বারান্দার গেটে তালা দেওয়া। ঘরের সামনের পুকুরে দুই শিশু সাঁতার কাটছে। তাদের কাছে জানতে চাইলে হাসান নামের এক শিশু জানায়, বাড়িটি এখন তাদের। তার বাবা মালয়েশিয়ায় থাকেন। ঘরে তার মা আছেন। কিন্তু তার মাকে ডাকাডাকি করা হলেও সাড়া দেননি।

প্রতিবেশী সুপ্রিয়া অধিকারী জানান, দলবল নিয়ে জোরজবরদস্তি করে জোছনাদের বের করে দেয়। প্রতিবাদ করায় তা‌দের নামে মামলার হুমকি দেয়। তাই ভয়ে তারা আর কিছু ব‌লেননি।

জানতে চাইলে কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইমদাদুল হক বলেন, ‘বিষয়টি সমাধানের জন্য চেষ্টা করেছি। অনেকটা জ‌টিল বিষয়টি। এ জন‌্য তাদেরকে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছি।’

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাস বলেন, ‘ঘটনাটি অমানবিক। যদি ওই অংশে তাদের জমি থেকে থাকে, তাহলে তা উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হবে। সেই সঙ্গে পরিবারটির যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেদিকেও খেয়াল নেওয়া হবে।’

ত‌রিকুল ইসলাম/এমজে

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর