Logo

সারাদেশ

‘প্রতারক’ সিকদার লিটনের সঙ্গে তৃপ্তির কীসের সখ্য?

Icon

বাংলাদেশের প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:৪৮

‘প্রতারক’ সিকদার লিটনের সঙ্গে তৃপ্তির কীসের সখ্য?

বিশিষ্ট এক ব্যক্তিকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতে মিথ্যা মামলার আবেদন ঠুকে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তৃপ্তি খানম (৩২) নামে এক নারীর বিরুদ্ধে। ঢাকার নারী ও শিশু আদালতে করা এই মামলার আবেদনে সাক্ষী হিসেবে রাখা হয়েছে সিকদার লিটন ও তার স্ত্রীসহ চারজনকে। যাদের মধ্যে কয়েকজন সাক্ষীই বলেছেন, তারা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন।

তৃপ্তি খানম তার অভিযোগে উল্লেখ করেন, ১৫, ১৬ ও ১৭ জানুয়ারি মিরপুরে তিনি ঘটনার শিকার হন। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই দিনগুলোতে তিনি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় ছিলেন। তিনি সেখানকার পদ্মা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডিউটিরত ছিলেন। হাজিরা খাতায় তার স্বাক্ষরও পাওয়া গেছে।

এছাড়া, মামলার আবেদনে তৃপ্তি খানম তার যে মোবাইল নম্বর (+৮৮০১৯৭৭২০৬৪...) ব্যবহার করেছেন, তার কল রেকর্ড বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ওই সময় তিনি ফরিদপুরেই অবস্থান করছিলেন। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক আরজিনা বেগমও নিশ্চিত করেন, ওই সময় তৃপ্তি সেখানে কর্মরত ছিলেন।

অভিযোগে সাক্ষী হিসেবে যে চারজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের মধ্যে একজন আলফাডাঙ্গার গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এনামুল হাসান। তিনি জানান, এই মামলার বিষয়ে কিছুই জানেন না এবং কেন তার নাম সাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটিও তার অজানা।

গোপালপুর ইউনিয়নেরই আরেক বাসিন্দা তবিবুর রহমান। তাকেও সাক্ষী হিসেবে দেখিয়েছেন তৃপ্তি। তবিবুর এ প্রতিবেদককে জানান, তিনি শুনেছেন এমন একটি মামলার আবেদনে সাক্ষী হিসেবে তার নাম দেওয়া হয়েছে। পরে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন অভিযোগকারী ওই নারীর সঙ্গে তিনি কোনোভাবেই সম্পর্কিত নন। 

অভিযোগে সিকদার লিটন নামে যে পুরুষ ও তার স্ত্রীকে সাক্ষী দেখানো হয়েছে তারাও আলফাডাঙ্গার বাসিন্দা। তাদেরকে একাধিকবার ফোন কল করেও পাওয়া যায়নি।

এদিকে, অনুসন্ধানে সিকদার লিটনের বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে গুরুতর তথ্য। পুলিশের তথ্য বলছে, লিটনের বিরুদ্ধে ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন থানায় প্রতারণা, জালিয়াতি, হুমকিসহ এক ডজনের বেশি মামলা রয়েছে। সাধারণ ডায়েরি (জিডি) রয়েছে দুই ডজন। 

ফরিদপুর জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সাল থেকে লিটন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ২০২৪ সালের অক্টোবরে জামিনে মুক্তি পান।

এরপর নতুন করে আবারও তার বিরুদ্ধে  মামলাবাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে কেরাণীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাভেদ নামে এক আসামিকে হত্যার অভিযোগ এনে আদালতে মামলার আবেদন করেন তিনি।

তবে নিহত জাভেদের ভাই মাইনুদ্দিন জানান, লিটনের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে লিটনকে মামলা করার বিষয়ে সম্মতি বা পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেওয়া হয়নি। লিটন একান্তই ব্যক্তিগত ইন্টারেস্ট থেকে মামলাটি করেছেন। এছাড়া সমাজের বিশিষ্টজনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে হয়রানির অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

প্রশ্ন উঠেছে, প্রতারক হিসেবে অভিযুক্ত এমন একজন ব্যক্তি ধর্ষণের অভিযোগে মামলার আবেদনে সাক্ষী হলেন কীভাবে? অভিযোগকারী নারী তৃপ্তির সঙ্গে লিটনের সম্পর্কই বা কীসের? সেই সূত্র খুঁজতে গিয়ে মেলে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য।

অনুসন্ধান বলছে, কারামুক্ত হয়েই ভোল বদলাতে শুরু করেন লিটন। বিশিষ্টজনের সম্মানহানির ভয় দেখিয়ে বাণিজ্যের নকশা আঁকেন। এরই অংশ হিসেবে মামলা বাণিজ্যের পার্টনার হিসেবে তৃপ্তির সঙ্গে জুটি গড়েন। দুজনে মিলে মিথ্যা ধর্ষণের মামলা সাজানোর পরিকল্পনা হাতে নেন। সেই অনুযায়ী তৃপ্তি মামলার আবেদন করেন আর সাক্ষী রাখা হয় লিটনকে।

সিকদার লিটন ও তৃপ্তি খানমের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজতে গিয়ে তাদের ফোনালাপের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গত ৫ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তারা অন্তত ৪৭ বার ফোনে কথা বলেছেন, যার মোট সময় প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা।

ফোনালাপের বিশ্লেষণ করা তথ্য মোতাবেক, ১৫ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টা ৪২ মিনিটে লিটনের সঙ্গে কথা হয় তৃপ্তির। এসময় তারা কথা বলেন ৯৯ সেকেন্ড। এর দুই মিনিট পর তারা পুনরায় ৯৯ সেকেন্ড কথা বলেন।

এছাড়া ১৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা ৪২ মিনিট ও ৪৩ মিনিটে পৃথকভাবে ২৮ সেকেন্ড করে কথা হয় দুজনের। একইদিন ১২টা ৯ মিনিট, ১২টা ২০ মিনিট, ১২টা ৩৫ মিনিট এবং ১২টা ৩৮ মিনিটে তাদের যথাক্রমে ৩১, ৩৪, ১৯৬ ও ১৯৫ সেকেন্ড কথা হয়। একই দিন বিকেল ৫টা ৪১ মিনিটে ৪৯৩ সেকেন্ড অর্থাৎ টানা আট মিনিটের বেশি কথোপকথন হয়।

পরের দিন ১৭ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা ২৮ মিনিট, ১০টা ৪৯ মিনিট, ১১টা ১৫ মিনিট ও ১১টা ১৮ মিনিটে তাদের প্রায় ১২ মিনিট কথা হয়। এছাড়া বেলা সোয়া ১২টায় পৃথকভাবে দুবার কথা হয় তাদের।

তৃপ্তি যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেছেন তিনি অভিযোগ করে বলেন, লিটন ও তৃপ্তি মিলে একটি চক্রের হয়ে কাজ করছেন। তারা সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মানহানির পাশাপাশি গুরুতর মিথ্যা অভিযোগ এনে টাকার বিনিময়ে সমাধানের প্রস্তাব দিচ্ছেন।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছর শাসনামলে নিজেকে দলটির দাবি করা লিটন এখন বিএনপির সমর্থক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। ডজনখানে জালিয়াতিক মামলার আসামি হওয়ায় গ্রেপ্তার এড়াতে নিচ্ছেন নানা কৌশল। তার বিরুদ্ধে প্রতারণা, জালিয়াতি ও চাকরি দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। 

ফরিদপুরের সচেতন মহল এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হয়রানি করতে কেউ যাতে ভুয়া মামলা ব্যবহার করতে না পারেন, সে বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

এও/ওএফ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর