Logo

অর্থনীতি

শতাধিক পণ্য ও সেবায় সরকার ভ্যাট বাড়াল কেন

Icon

বিবিসি

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭:২৭

শতাধিক পণ্য ও সেবায় সরকার ভ্যাট বাড়াল কেন

গ্রাফিক্স : বাংলাদেশের খবর

বাংলাদেশে অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে হুট করে শতাধিক পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বাড়ানোর পাশাপাশি ট্রাকে করে টিসিবির পণ্য বিক্রি বন্ধ হওয়ার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক দল ছাড়াও অর্থনীতিবিদ ও ভোক্তারা সরকারের এ পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করছেন।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দিক থেকে এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া না হলেও অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজস্ব আদায়ে ধ্স নামার প্রভাব ঠেকাতে এবং আইএমএফ’র কাছ থেকে অতিরিক্ত এক বিলিয়ন ডলার পাওয়ার জন্যই সরকার ‘কর আদায়ের এ সহজ পথ’ বেছে নিয়েছে।

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণের অনুমোদন দিয়েছিলো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। এই ঋণের তিন কিস্তির টাকা ইতোমধ্যেই ছাড় করা হয়েছে এবং চতুর্থ কিস্তির টাকাও দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

কিন্তু এরই মধ্যে আইএমএফ’র কাছ থেকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আরও এক বিলিয়ন ডলার সহায়তা চাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, আইএমএফ এর সাথে আলোচনার সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দরকষাকষিতে অদক্ষতার কারণেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হয়েছে।

‘আইএমএফ’র শর্ত অনুযায়ী সরকারকে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে। গত কয়েক বছর সরকার এটি পারেনি এবং সেজন্যই মনে হয় এখন সরকার একটি সহজ পথ বেছে নিয়েছে,’ বলছিলেন অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফিজুর রহমান।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ বলছেন, ‘এভাবে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর বিষয়ে সরকারের লোকজন একমত হলেন কীভাবে-সেটাই আশ্চর্য হওয়ার মতো একটা বিষয়।’

অবশ্য ভ্যাট বা কর বাড়ানোর সরকারি উদ্যোগের বিষয়ে গত ২ জানুয়ারি অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। তখন তিনি বলেছিলেন যে, জরুরি পণ্যের শুল্ক কমিয়ে ‘শূন্য’ করা হয়েছে।

কীসে বেড়েছে শুল্ক ও কর
বৃহস্পতিবার রাতে দুটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে শুল্ক ও কর বাড়ানো হয়েছে শতাধিক পণ্য ও সেবায়। মূলত আমদানি, উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাট, সম্পূরক ও আবগারি শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা (এনবিআর)-এর ভ্যাট বিভাগ শুক্রবার এ সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করার কারণে নতুন অধ্যাদেশ সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়ে গেছে।

ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর বাড়ানোর কারণে মোবাইল ফোনে কথা বলা, ইন্টারনেট ব্যবহার, জামা কাপড়, রেস্তোরার খাবার, ওষুধ, মিষ্টি, ফলের রস ও এলপি গ্যাসসহ অনেক খাতেই মানুষের খরচ বেড়ে যেতে পারে।

মিরপুর কাজীপাড়ায় বাস করেন আফসানা বেগম। তিনি বলছেন, বাজারে সব জিনিসের দাম বেড়েছে। ওষুধের দাম গত তিন বছর ধরে বেড়েই চলেছে। আর কত বাড়াবে এর দাম।’

আমিনুল ইসলাম বেসরকারি একটি কারখানায় চাকরি করেন আশুলিয়ায়। তিনি বলছেন, গত জানুয়ারিতে ফার্মগেটের একটি রেস্টুরেন্টে এক বাটি হালিম খেয়েছিলাম ৮০ টাকা। এই শুক্রবার বিকেলে ওই একই রেস্টুরেন্টে এক বাটি হালিমের দাম রেখেছে ১৩০ টাকা। এরপরেও বাড়াতে হবে?

অধ্যাদেশের মাধ্যমে এভাবে শুল্কহার বাড়ানোর বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রি বা ডিসিসিআই। সংগঠনটি বলেছে, সরকারের এমন সিদ্ধান্তের কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে পণ্যের মূল্য বাড়বে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ কমবে।

বিকল্প কী হতে পারতো
জানা গেছে, আইএমএফ এর শর্ত হলো চলতি বছর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে, যা সরকার করতে পারেনি। আবার জুলাই অগাস্টের আন্দোলনের সময় অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ায় রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এই প্রান্তিকে রীতিমতো বিপর্যয় হয়েছে এবং এই পরিস্থিতির কীভাবে উন্নতি হবে তা নিয়ে উদ্বেগ আছে।

সরকারি হিসেবে- চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব আদায় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এক শতাংশ কমেছে। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আদায় করেছে এক লাখ এক হাজার ২৮১ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অন্তত ৩১ হাজার কোটি টাকা কম।

তবে পরিস্থিতির উন্নতি হোক আর না হোক আইএমএফ এর সাথে সরকারের যে ঋণচুক্তি তাতে করে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি অনুপাতে কর সংগ্রহ শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ পয়েন্ট বাড়াতে হবে।

অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলছেন, আইএমএফ এর ঋণের প্রথম তিন কিস্তির সময় রাজস্ব বাড়ানো বা কর-জিডিপি অনুপাতের ক্ষেত্রে যে শর্ত ছিলো বাংলাদেশ তা পূরণ করতে পারেনি। ফলে এবার সংস্থাটি আরও চাপ বাড়িয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

‘এখন সরকার আরও এক বিলিয়ন ডলার চাইছে। ফলে আইএমএফও আরও শক্ত করে চাপ দিচ্ছে। এ কারণেই এভাবে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে বলে মনে হচ্ছে,’ বিবিসিকে বলছিলেন তিনি।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় আইএমএফ এর শর্ত অনুযায়ী শূল্ক বা ভ্যাট এভাবে না বাড়িয়ে সরকার আর কী পদক্ষেপ নিতে পারতো- জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার প্রত্যক্ষ কর বাড়ালে এবং কর ফাঁকি রোধে উদ্যোগী হলে সাধারণ মানুষের ওপর এ চাপ তৈরি করতে হতো না।

‘এখন সুযোগ ছিলো টিআইএন নম্বরধারীদের রিটার্ন সাবমিট নিশ্চিত করা এবং করযোগ্য যারা করের আওতার বাইরে আছেন তাদের করের আওতায় নিয়ে আসার। কিন্তু সেই কাজে উদ্যোগী না হয়ে সরকার সহজ পথ বেছে নিয়েছে,’ বলছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান।

যদিও কিছু ক্ষেত্রে সরকার ব্যয় সাশ্রয় করা এবং উন্নয়ন পরিকল্পনায় কাটছাঁট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপরেও শুল্ক ও কর বেড়ে যাওয়ায় অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে বা বাড়বে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশংকা তৈরি হয়েছে।

আরেকজন অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ মনে করছেন, সরকার এভাবে ঢালাও ভাবে শুল্ক কর না বাড়িয়ে সম্পত্তি কর বাড়ালে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়াতে হতো না।

‘নানা রকম সম্পদের ওপর কর দেয়া যেতো। যেমন একাধিক বাড়ি বা গাড়ির ক্ষেত্রে কর পুনর্বিন্যাস করতে পারতো। সম্পদের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে করের স্লাব নির্ধারণ করা যেতো। দুর্নীতিবাজ যাদের সম্পদ জব্দ হয়েছে বা অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ হয়েছে সেগুলোকে ব্যবহার করা যেতো।’

'‘এতে করে বৈষম্য কমতো, দুর্নীতি দমন ও লুটপাটকারীদের শাস্তির কর্মসূচি অগ্রসর হতো এবং মুদ্রাস্ফীতিতে কোনো বাড়তি চাপ পড়তো না,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

এম এম আকাশ মনে করেন, সরকারে অন্তর্বর্তীকালীন হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদী কোনো পরিকল্পনা তারা নিতে পারছে না, ফলে তাদের এসব সিদ্ধান্তে জন অস্বস্তি বাড়ছে।

‘তাদের উচিত এখন জনগণকে স্বস্তি দিতে সংস্কার কাজগুলো শুরু করে ক্ষমতা নির্বাচিত সরকারকে হস্তান্তর করা,’ বলছিলেন তিনি।

এদিকে, বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভ্যাট ট্যাক্স বাড়ানোর ঘোষণার তীব্র সমালোচনা করেছে। সূত্র : বিবিসি

বিএইচ/

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর