জসিম উদ্দিন নামে এক সরকারি চাকুরে তার অসুস্থ মেয়ের জন্য এক ব্যাগ রক্তের সন্ধান করছিলেন। আমতলী শহরের জামে মসজিদে নামাজ পড়তে আসা সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা সজিব ঘটনাটি শুনে তাকে আশ্বস্ত করলেন। প্রয়োজনে যেকোনো সময়ে যেকোনো গ্রুপেরই হোক না কেন, অন্তত রক্তের অভাবে কাউকে মরতে হবে না। আমতলী উপজেলাসহ দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় একঝাঁক তরুণ রক্ত দানের জন্য সব সময়ে তৈরি রয়েছেন। এরা নিজেদের ‘রক্তযোদ্ধা’ ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। যেকোনো রোগীর প্রয়োজনে তারা ছুটে গিয়ে রক্ত দান করেন। দূরত্ব বা সময় এদের কাজের দৃঢ়তার কাছে ইতোমধ্যেই হার মেনেছে।
বরগুনার আমতলী উপজেলায় ২০১৫ সালে কিছু উদ্যমী তরুণ গঠন করেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সময়’। শুরুতেই তারা রক্তদানের মাধ্যমে আর্ত-মানবতার সেবায় এগিয়ে আসেন। গোড়ার দিকে আমতলী উপজেলার বিভিন্ন রোগীর প্রয়োজনে রক্ত দেওয়া শুরু করেন তারা। রক্তদানের মহতী কাজে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় নানা মতাদর্শ, বর্ণ, শ্রেণি-পেশার তরুণ-কিশোররা।
আমতলীতে সংগঠনের প্রধান কার্যালয়ের মাধ্যমে বরিশাল বিভাগের সবক’টি জেলাসহ রাজধানী ঢাকা, নরসিংদী, খুলনা ও যশোরে সংগঠনের বিস্তার ঘটিয়েছে। সারা দেশে তাদের প্রায় ৭শ’ সদস্য ও ৩শ’ রক্তদাতা সদা তৈরি থাকেন। ‘সময়’-এর সমন্বয়কারী প্রকৌশলী রাকিবুল ইসলাম রাজু চৌধুরী জানান, গত কয়েক বছরে দেড় হাজারের বেশি মানুষকে তারা রক্ত দিয়েছেন। কর্মীরা যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, সুবিধামতো স্থানে ছুটে গিয়ে নিজ খরচে রক্তদান করে আসছেন। সময় সংগঠনের নানাবিধ কার্যক্রম থাকায় তারা এই রক্তযোদ্ধাদের একটি সাংগঠনিক কাঠামোতে ধরে রেখেছেন। সেটির নাম দিয়েছেন ‘সময়ের স্পন্দন’।
বরিশাল স্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক উপপরিচালক ডা. মোশতাক আল মেহেদী জানালেন, সময়ের আরেকটি ভিন্নধর্মী উদ্যোগ হলো প্যালিটিভ কেয়ার। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একেবারেই আনকোরা। ক্যানসার আক্রান্ত মৃত্যু পথযাত্রী রোগীদের শেষ সময়ে চিকিৎসায় সহযোগিতা, পরামর্শ, বেঁচে থাকার উৎসাহ প্রদান করার বিষয়টি নিয়েই এই প্যালিটিভ কেয়ার কার্যক্রম। সময়ের সমন্বয়ক রাজু চৌধুরী জানান, বঙ্গবন্ধু চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সময়ের কর্মীদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
নিজেদের উপার্জিত অর্থের একটা অংশ সংগঠনে জমা করে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সময়ের তরুণরা গুণীদের স্বীকৃতি, ত্রাণ কার্যক্রম, শিশু শিক্ষা, শিক্ষা উপকরণ প্রদান, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা, নিরাপদ সড়ক, বৃক্ষরোপণ, পরিচ্ছন্নতা অভিযানসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। উদযাপনসহ পালন করছে বিভিন্ন দিবসের কার্যক্রমও। আয়োজন করে সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলার প্রতিযোগিতা। তাদের নতুন সংযোজন একেবারে স্বল্প ব্যয়ে তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক প্রশিক্ষণ।
সংগঠনের একজন কর্মী মাজহারুল ইসলাম জানান, প্রকৌশলী, সরকারি-বেসরকারি চাকুরে, খেলোয়াড়, শিল্পী, কারিগরি কর্মী-প্রশিক্ষক নানা পেশার মানুষের মিলনমেলা তাদের ‘সময়’। তাই সময়ের কার্যক্রমও বিভিন্ন মাত্রিক। সময়ের রক্তযোদ্ধা রবিনের মতে, রক্ত দিয়ে শুরু করেছি। যার যার অবস্থান থেকে যত সামান্যই হোক, মানবতার সেবায় সবাই কাজ করলে এ দেশ থেকে দুর্দশা পালাবেই।
বরগুনার আমতলীর উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা জিএম দেলোয়ার বলেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক সঙ্কীর্ণতা পরিহার করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা যেভাবে আর্ত-মানবতার সেবায় উদ্যমী ভূমিকা রাখছে তা দৃষ্টান্তমূলক। ভালো মানুষদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দেশের মঙ্গল বয়ে আনে।