কামরুল হাসান কামরান, সিংড়া (নাটোর)
সিংড়া। নাটোরের একটি উপজেলা। ৫৮৭ বর্গকিলোমিটারের ৪৫৬টি গ্রাম ও চলনবিলের বেশকিছু অংশ নিয়ে সিংড়া উপজেলা গঠিত। কথায় আছে, বিল দেখো তো চলন আর গ্রাম দেখো তো কলম। এ দুটি বিখ্যাত জায়গার সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে আপনাকে আসতে হবে সিংড়ায়। প্রকৃতি ভালোবাসে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রকৃতির তিনটি মোহনীয় রূপে আপনি চলনবিলকে উপভোগ করতে পারবেন।
সিংড়ার বালুয়া বাসুয়া মোড় থেকে তারাসের বারুহাস পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার রাস্তা চলনবিলের বুক চিরে চলে গেছে। বর্ষাকালে এই রাস্তা পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে বলে এটি হয়ে ওঠে অপার সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি। রাস্তার এপার থেকে ওপারে পানি প্রবাহিত হওয়ায় বিভিন্ন বয়সী বিনোদনপিপাসু মানুষ মনের আনন্দে মেতে ওঠে জলতরঙ্গ খেলায়। কেউবা গোসল করছেন, কেউবা সাঁতার কাটছেন, কেউ ধরছেন মাছ, কেউবা আবার আনন্দঘন মুহূর্তকে স্মৃতিময় করে রাখতে ক্যামেরাবন্দি হচ্ছেন।
তরুণরা যখন তাদের শখের বাইকটি নিয়ে ডুবন্ত রাস্তা পাড়ি দেয়, তখন মনে হয় অথৈ পানির ওপর দিয়ে তারা যেন বাইক নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। বর্ষাকালে চলনবিলের একেকটি গ্রামকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় সাগরের মাঝে একেকটি দ্বীপ। চলনবিলে এলে দেখতে পাবেন একটি লম্বা তালগাছ এবং সুবিশাল বটগাছ নিয়ে দ্বীপের মতো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘাসী পীরের মাজার। সেখানে হাজার হাজার ভক্ত নৌকা নিয়ে ছুটে আসেন তাদের মনোবাসনা পূরণের জন্য। শুধু তা-ই নয়, মাজারকে ঘিরে জমে ওঠে বাউল গানের আসর। এ ছাড়া দেখতে পাবেন গ্রাম্যবধূরা পালতোলা ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে বাবার বাড়ি নাইওর খেতে যায়।
ধানের নৌকা, খড়ের নৌকার মাঝিরা নৌকা ছেড়ে আপন মনে ভাটিয়ালি গান গায়। জেলেরা খড়া জাল, খেয়া জালসহ নানা ধরনের উপকরণ দিয়ে মাছ শিকার করে যা আপনার মন কাড়বেই। চলনবিলের সৌন্দর্যমণ্ডিত আরো কিছু দর্শনীয় স্থানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঐতিহ্যবাহী বিলশা ও কুন্দইল গ্রাম, যার চারপাশে কংক্রিটের ব্লক দিয়ে ঘেরা পাড়ের ওপর যখন জলরাশির বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে, তখন আপনি কিছু সময়ের জন্য হলেও অন্য জগতে হারিয়ে যাবেন। গোধূলিলগ্নে নৌকায় চড়ে ঘুরতে গেলে দেখবেন বিস্তৃত জলরাশি যেন অস্তমিত সূর্য এবং রাঙা আকাশের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, যা দেখে আপনার আর ঘরে ফিরতে ইচ্ছা করবে না। চাঁদনি রাতে এখানে আপনি দেখতে পাবেন জল-জ্যোৎস্নার খেলা। আপনি চাইলেই বিনোদনের জন্য এখানে পাবেন পালতোলা নৌকা, ঠেলা নৌকা, ইঞ্জিনচালিত নৌকা, স্পিডবোট ইত্যাদি। এ ছাড়া সববয়সী মানুষের বিনোদনের জন্য এখানে রয়েছে চলনবিল পর্যটন পার্ক। খাওয়ার জন্য এখানে পাবেন ঐতিহ্যবাহী চলনবিলের হরেক প্রজাতির তাজা মাছ। বর্ষাকালে সব শ্রেণির, সব বয়সী হাজার হাজার বিনোদনপিপাসু তাদের মন প্রশান্ত করতে ছুটে আসে চলনবিলে। শীতকালে দিগন্তজুড়ে হলদে সরিষা ফুলের নয়নপ্রসন্ন করা যে রূপ, তা আপনাকে মাতাল করবেই। এ ছাড়া আগমন ঘটে নানা প্রজাতির অতিথি পাখির। চলনবিলে পাবেন নানা ধরনের দেশি খাবার এবং চলনবিলের নানা প্রজাতির তাজা মাছ। অনেক দেশি খাবারের হোটেল এবং ফাস্টফুডের দোকান ও পর্যাপ্ত মুখরোচক খাবারের দোকান রয়েছে। থাকার জন্য এখনো বাণিজ্যিকভাবে কোনো আবাসিক হোটেল বা মোটেল গড়ে না উঠলেও রয়েছে পৌর গেস্ট হাউজ ও উপজেলা ডাকবাংলো। এখানে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আরো কিছু আবাসিক হোটেল-মোটেলসহ পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় বিনোদন কেন্দ্র গড়ে উঠলে এবং রাস্তাঘাট একটু উন্নত ও সংস্কার করলে বেশি বেশি পর্যটকের আগমন ঘটত।
বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে এখানে আপনি আসতে চাইলে সড়কপথে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কে সিংড়া বাসস্ট্যান্ডে আসতে হবে। সেখান থেকে খুব সহজে সিএনজি, ইজিবাইক, রিকশা-ভ্যান এমনকি হেঁটেও পৌঁছাতে পারবেন আমাদের প্রিয় চলনবিলে।