• শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪২৮
বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা

নাটোরের প্রসিদ্ধ কাঁচাগোল্লা

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা

  • নাটোর প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ০৯ অক্টোবর ২০১৮

স্বাদে অতুলনীয় মিষ্টান্ন ‘নাটোরের কাঁচাগোল্লা’। নামে কাঁচাগোল্লা’ হলেও এ মিষ্টান্ন কিন্তু কাঁচা নয়। খাঁটি দুধের তৈরি ছানা আর পরিমাণমতো চিনি দিয়ে তৈরি হয় এ কাঁচাগোল্লা। কাঁচাগোল্লা তৈরির সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত ছিলেন, সেসব কারিগরের উত্তরসূরিদের বেশিরভাগই ভারত ও পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার পর ভারতে চলে যান। অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। সর্বোপরি কাঁচাগোল্লা নিয়ে কোনো গবেষণার কথাও শোনা যায় না। তাই কাঁচাগোল্লার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা দুরূহ ব্যাপার। আনুমানিক আড়াই শ’ বছর পূর্বেও নাটোরের কাঁচাগোল্লার কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। সুপ্রাচীনকাল থেকে মিষ্টি রসিকদের রসনা তৃপ্ত করে আসছে এই মিষ্টি। ১৭৫৭ সাল থেকে এই মিষ্টি ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ।

নাটোরের প্রসিদ্ধ এক মিষ্টির দোকান থেকে প্রতিদিন ট্রেনে করে ৪০-৫০ টিন বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি কলকাতায় যেত। মিষ্টির টিনের গায়ে লেখ থাকত মধুসূদন দাস।

নাটোর শহরের শুকুলপট্টি এলাকার লোকজনদের মধ্যে জনশ্রুতি রয়েছে, নাটোরের রাজস্ট্যাটের বড় তরফের রাজা গোবিন্দনাথের স্ত্রী ব্রজসুন্দরীর দত্তকপুত্র মহারাজা জগিন্দ্রনাথ রায় একটু খেয়ালী প্রকৃতির ছিলেন। একদিন গভীর রাতে মিষ্টি খাওয়ার বায়না ধরেন তিনি। ডাকা হলো রাজ  কারিগরকে। কিন্তু এত রাতে কোথায় পাওয়া যাবে মিষ্টি? কীভাবেই বা  মিষ্টি তৈরি হবে? হঠাৎ কারিগর গাভি দুইয়ে দুধ সংগ্রহ করে সেই দুধ  উনুনে জ্বাল দিয়ে ছানা তৈরি করে তাতে চিনি মিশিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে সুস্বাদু মিষ্টি তৈরি করে মহারাজাকে খেতে দিলেন। মহারাজা খেয়ে খুব খুশি। এমন স্বাদের মিষ্টির নাম জানতে চাইলেন তিনি কারিগরের কাছে। কারিগর কোনো কিছু চিন্তাভাবনা না করেই বললেন কাঁচাগোল্লা।

এ ছাড়াও কাঁচাগোল্লা সৃষ্টির রয়েছে চমৎকার কাহিনি। নিতান্ত দায়ে পড়েই নাকি তৈরি হয়েছিল এই মিষ্টি। নাটোর শহরের লালবাজারের মধুসূদন পালের দোকান ছিল নাটোরের প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান। দোকানে বেশ কয়েকটি বড় বড় চুলা ছিল। মধুসূদন এসব চুলায় দেড় থেকে দুই মণ ছানা দিয়ে রসগোল্লা, পানতোয়া, চমচম, কালোজাম প্রভৃতি মিষ্টি তৈরি করতেন। দোকানে কাজ করতেন ১০-১৫ কর্মচারী। হঠাৎ একদিন মিষ্টির দোকানের কারিগর আসেনি। মধুসূদনের তো মাথায় হাত! এত ছানার এখন কী হবে? এই চিন্তায় তিনি অস্থির। নষ্টের হাত থেকে রক্ষা পেতে ছানাতে তিনি চিনির রস ঢেলে জ্বাল দিয়ে নামিয়ে রাখতে বলেন। এরপর মুখে দিয়ে দেখা যায় ওই চিনি মেশানো ছানার দারুণ স্বাদ হয়েছে। নতুন মিষ্টির নাম কী রাখা হবে, এই নিয়ে শুরু হয় চিন্তাভাবনা। যেহেতু চিনির রসে ডোবানোর পূর্বে ছানাকে কিছুই করতে হয়নি অর্থাৎ কাঁচা ছানাই চিনির রসে ঢালা হয়েছে (রসগোল্লাার ছানাকে তেলে ভেজে চিনির রসে ডোবানো হয়), তাই তার নামকরণ হয়েছে কাঁচাগোল্লা।

কাঁচাগোল্লার স্বাদ রসগোল্লাা, পানতোয়া এমনকি অবাক সন্দেশকেও হার মানিয়ে দেয়। এর রয়েছে একটি মিষ্টি কাঁচা ছানার গন্ধ, যা অন্য কোনো মিষ্টিতে পাওয়া যায় না। ধীরে ধীরে মিষ্টি রসিকরা এই মিষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। তখন থেকে মধুসূদন নিয়মিতই এই মিষ্টি বানাতে থাকেন। কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কাঁচাগোল্লার চাহিদা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে মধুসূদন পালের দোকানে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন মণ ছানার কাঁচাগোল্লা তৈরি হতে লাগল। সে সময় ঢোল বাজিয়ে জানানো হতো কাঁচাগোল্লার কথা।

কাঁচাগোল্লার উপাদান :

খাঁটি দুধের ছানা ও চিনি কাঁচাগোল্লা তৈরির প্রধান উপাদান। ১ কেজি কাঁচাগোল্লা তৈরি করতে প্রায় ১ কেজি কাঁচা ছানা ও ৪০০ গ্রাম চিনির প্রয়োজন। কড়াইতে চিনিগুলো পানিসহ জ্বাল দিতে হয়। চিনি পরিষ্কার করতে সামান্য কাঁচা দুধ দিতে হয়। কড়াইয়ের গাদ ময়লা পরিষ্কার হয়ে গেলে কড়াইয়ে ছানা ঢেলে দিতে হয়। এরপর জ্বাল এবং একই সঙ্গে কাঠের খড়া দিয়ে নাড়তে হয়। এভাবেই ৩০ থেকে ৪০ মিনিট ধারাবাহিকভাবে নাড়তে নাড়তেই পরিপূর্ণ কাঁচাগোল্লা তৈরি হয়ে যাবে। তবে এই নাড়াচাড়ার মধ্যেই রয়েছে শৈল্পিক কৌশল। মোটামুটি এই হচ্ছে ১ কেজি কাঁচাগোল্লার হিসাব।

কাঁচাগোল্লা তৈরির জন্য প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন ভান্ডারের পরিচালক এমএ রউফ খান জানান, তারা কাঁচাগোল্লাতে এলাচ ব্যবহার করেন না। এতে প্রকৃত কাঁচা ছানার গন্ধ পাওয়া যায়।

দেশ-বিদেশে কাঁচাগোল্লা : ১৭৬০ সালে অর্ধবঙ্গেশ্বরী বাংলার দানশীলা শাসনকর্তা রানী ভবানীর রাজত্বকালে কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়াতে থাকে। সেই সময় নাটোরে মিষ্টির দোকান ছিল খুবই কম। এসব দোকানে বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা ছাড়াও অবাক সন্দেশ, রাঘবশাহী, চমচম, রাজভোগ, রসমালাই, পানতোয়া প্রভৃতি মিষ্টি ছিল অন্যতম। তবে এর মধ্যে সবার শীর্ষে উঠে আসে কাঁচাগোল্লা। ফলে সে সময় রাজা-জমিদারদের মিষ্টিমুখ করতে ব্যবহূত হতো এই বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা। এমনকি বিলেতের রাজপরিবারেও এই কাঁচাগোল্লা নেওয়া হতো। এছাড়া নেওয়া হতো ভারতবর্ষের সর্বত্র।

রাজশাহী গেজেট পত্রিকাতেও কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতির কথা বলা হয়েছে। কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে সেই সময় কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। কলকাতা এবং নাটোর শহর একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এবং এই দুই শহরের ঘনিষ্ঠ সর্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকায় ভারত, ইংল্যান্ডসহ তৎকালীন বিভিন্ন রাষ্ট্রে নাটোরের কাঁচাগোল্লার কথা ছড়িয়ে পড়ে।

কোথায় পাবেন ভালো কাঁচাগোল্লা : নাটোরের কিছু উল্লেখযোগ্য দোকান ছাড়া এই মিষ্টি কিনে ঠকার সম্ভাবনা রয়েছে। লালবাজারের মধুসূদন পালের দোকান, শহরের আলাইপুর মৌচাক ভান্ডার, চকরামপুরে ইসলামিয়া পচুর হোটেল, কেন্দ্রীয় মসজিদের নবপুর, নিচা বাজারের কুণ্ডু মিষ্টান্ন ভান্ডার, অনুকূল দধি ও মিষ্টান্ন ভান্ডার, স্টেশন বাজারের নয়ন ও সকাল-সন্ধ্যায় ভালো মিষ্টি পাওয়া যায়। তবে বর্তমানে কাঁচাগোল্লা বিক্রিতে শীর্ষে রয়েছে মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডার। এদের রয়েছে নিজস্ব ৩৮টি গাভি। নিজস্ব জমিতে গো-খাদ্য হিসেবে এরা ঘাসও চাষ করে।

কাঁচাগোল্লার দাম : বর্তমানে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এবং কলকাতায় যাওয়ার সময় নাটোরের কাঁচাগোল্লা নিয়ে যেতে কেউই ভুল করেন না। কাঁচাগোল্লার বর্তমান মূল্য প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান মৌচাকে ৩৫০ টাকা কেজি। জনশ্রুতি রয়েছে ১৮৪০ সালের দিকে দিঘাপতিয়ার রাজা প্রসন্ন নাথ রায়ের আমলে শ্রীকৃষ্ণের ঝুলন উৎসবের দিনে উপস্থিত ধর্মপরায়ণ সবাইকেই এক বেলচা করে কাঁচাগোল্লা বিতরণ করা হতো। সে সময় প্রতি সের কাঁচাগোল্লার মূল্য ছিল ৩ আনা। তবে বর্তমানে নাটোরের কাঁচাগোল্লা বিক্রি হচ্ছে সাড়ে  ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads