• শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪২৮
মিঠা পানির শুঁটকির চাহিদা বাড়ছে দেশে ও বিদেশে

বর্তমানে নাটোর জেলায় মাছের উৎপাদন হয় ৫০৯৯৭.০০ টন

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

মিঠা পানির শুঁটকির চাহিদা বাড়ছে দেশে ও বিদেশে

  • নাটোর প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ০৯ অক্টোবর ২০১৮

উত্তরাঞ্চলের মৎস্যভান্ডার খ্যাত চলনবিলে চলছে মাছ ধরা ও শুকানোর ভরা মৌসুম। এই বিলের মিঠা পানির সুস্বাদু শুঁটকি মাছের চাহিদা বেড়েছে দেশে ও বিদেশে। এখানকার উন্নতমানের শুঁটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমেরিকা, সৌদি আরব, দুবাই, ইরাক, কাতার, ওমান, বাহরাইন, কুয়েত, লিবিয়া, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াসহ ২৫টি দেশে রফতানি করা হচ্ছে। তবে শুঁটকি সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এসব শুঁটকি নষ্ট হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এ পেশার সঙ্গে জড়িত উৎপাদনকারী এবং ব্যবসায়ীরা। শুঁটকি তৈরির কাজে জড়িত রয়েছে চলনবিলের কয়েক হাজার পরিবার। এসব পরিবারের নারী ও পুরুষ সদস্যরা হাজিরায় কাজ করছেন শুঁটকির চাতালে।

নাটোর জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, জলায়তন মোট ৬২ হাজার ২০৬ হেক্টর, মুক্তজলাশয় ৫৫ হাজার ৪১২ হেক্টর, নদী মোহনা ৪৩ হাজার ৪৭ হেক্টর, বিল ৩ হাজার ৮২ হেক্টর, প্লাবন ভূমি ৪৭ হাজার ৯৮৩ হেক্টর, বদ্ধজলাশয় ৬ হাজার ৭৯৪ হেক্টর, পুকুর ৬ হাজার ৩৮২ হেক্টর, মৌসুমি জলাশয় রয়েছে ৪১২ হেক্টর।

বর্তমানে নাটোর জেলায় মাছের উৎপাদন হয় ৫০৯৯৭.০০ টন। যার মধ্যে উন্মুক্ত জলাশয়ে দেশীয় প্রজাতির ১৫৭১১.০০ টন মাছ উৎপাদিত হচ্ছে। জেলার চাহিদা রয়েছে ৩৭ হাজার ৩৭৬ টন। এ চাহিদা মিটিয়েও ৮ হাজার ১৩ হাজার ৬২০ টন মাছ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। এখানকার দেশীয় মাছকে কেন্দ্র করে চলনবিলে গড়ে উঠেছে ২৫০ থেকে ৩০০টি অস্থায়ী শুঁটকির চাতাল। বর্তমানে চলনবিলের পানি কমতে থাকায় বিভিন্ন স্থানে জেলেদের জালে ধরা পড়ছে টেংরা, কই, মাগুর, শিং, বাতাসি, চিংড়ি, পুঁটি, খলসে, চেলা, নলা, টাকি, গুচিবাইম, বোয়াল, ফলি, কাতল, নওলা, শোল ও গজারসহ নানা জাতের মাছ। এসব মাছ চাতালে শুকিয়ে উৎপাদন করা হচ্ছে শুঁটকি। দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়ীরা সরাসরি চাতাল থেকে পছন্দের শুঁটকি কিনে নিয়ে যান। চলনবিলের কয়েক হাজার পরিবার মৌসুমি শুঁটকি তৈরির কাজে ব্যস্ত। এসব পরিবারের নারী-পুরুষ দিন হাজিরায় কাজ করছেন শুঁটকি চাতালে। কাজের ধরন অনুয়ায়ী তারা মজুরি পাচ্ছেন ১২০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। তিন কেজি তাজা মাছ শুকিয়ে এক কেজি শুঁটকি তৈরি হয়। প্রকার ভেদে প্রতিমণ শুঁটকির বাজারমূল্য ১ হাজার ৬শ’ থেকে ২ হাজার টাকা হয়।

শুঁটকি ব্যবসায়ী রেজাউল করিম জানান, প্রতিকেজি তাজা পুঁটি মাছ ৬০, বেলে ও কাঁকিলা ৬০, টেংরা ১৫০, টাকি ১০০, চিংড়ি ১০০ থেকে ১১০, চাঁদা মাছ ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সিংড়া উপজেলার বিলদহর গ্রামের মৌসুমি শুঁটকি ব্যবসায়ী আবদুল খালেক জানান, প্রায় ষাট বছর ধরে এ পেশার সঙ্গে জড়িত। আগে চলনবিল থেকে আহূত বিপুল পরিমাণ মাছ অবিক্রীত থাকত। এসব অবিক্রীত মাছ পরে শুঁটকি চাতাল মালিকরা স্বল্প মূল্যে কিনে শুঁটকি তৈরি করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করতেন। আর এখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বেপারিরা চলনবিলের মাছ ও শুঁটকি কিনে নিয়ে যান দেশের বিভিন্ন স্থানে।

নাটোর-বগুড়া মহাসড়কে নেঙ্গইন শুঁটকির চাতালে কর্মরত নারী শ্রমিক আসমা খাতুন জানান, তিন কেজি তাজা মাছ শুকিয়ে এক কেজি শুঁটকি হয়। যার বাজার মূল্য মান অনুযায়ী ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। যখন ২০ থেকে ২৫ টাকা করে মজুরি ছিল আমরা তখন থেকে এই শুঁটকির চাতালে কাজ করে আসছি।

চাতাল মালিক মজিবুর রহমান জানান, চলনবিলের শুঁটকির মান ভালো। তাই দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলনবিলের শুঁটকির চাহিদা রয়েছে। চলতি মৌসুমে চলনবিলে প্রায় ২০০টির ওপর অস্থায়ী চাতালে শুঁটকি তৈরি করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শুঁটকি তৈরির চাতাল মালিকরা এখানে আস্তানা গেড়েছেন। সাধারণত দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে এ ব্যবসা শুরু করা যায়। জেলেদের থেকে মাছ কিনে নিজেরা চাতালে শুকিয়ে উৎপাদন করা হয় শুঁটকি। আর শুঁটকি তৈরির কাজে জড়িত রয়েছে চলনবিলের কয়েক হাজার পরিবার। এসব পরিবারের নারী ও পুরুষ সদস্যরা হাজিরায় কাজ করছেন শুঁটকির চাতালে।

নাটোরের নলডাঙ্গার রায়সিংপুরের বাসিন্দা ও হালবিলের শুঁটকি ব্যবসায়ী ফুলচাঁদ জানান, শুঁটকি ব্যবসায় জড়িত হয়ে তারা আর্থিক সচ্ছলতার দেখা পেয়েছেন ঠিকই, তবে এ ব্যবসায় ঝুঁকিও অনেক বেশি। ঠিকমতো শুঁটকির পরিচর্চা করতে না পারলে অনেক ক্ষেত্রে শুঁটকি নষ্ট হয়ে যায়। আর এ ধরনের সমস্যায় পড়লে মূলধন খোয়ানো ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। সব কিছুর পরও সরকারিভাবে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করা হলে তারা এ ব্যবসায় আরো উপকৃত হবেন।

সৈয়দপুরের শুঁটকি ব্যবসায়ী এখলাছ উদ্দিন মিয়া জানান, দেশের বড় ব্যবসায়ীরা সরাসরি চাতাল থেকে পছন্দের শুঁটকি কিনে নিয়ে যান। শুঁটকির মান ভেদে ‘এ’ ‘বি’ ও ‘সি’ গ্রেডে বাছাই করা হয়। ‘এ’ গ্রেডের (ভালো মানের) শুঁটকি মাছ আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, বাহরাইন, দুবাই, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ ২৫টি দেশে রফতানি করা হচ্ছে। সাধারণত এসব দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে রয়েছে চলনবিলের সুস্বাদু শুঁটকির কদর। তা ছাড়া ‘সি’ ও ‘বি’ গ্রেডের শুঁটকি মাছ দেশের ভেতরে দিনাজপুর, সৈয়দপুর, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়ে থাকে।

গুরুদাসপুর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আবদুদ দাইয়ান জানান, চলনবিলের শুঁটকির মান ভালো। দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলনবিলের শুঁটকির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এতে স্থানীয় অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রায় সচ্ছলতার প্রভাব পড়ছে। একসময়ের প্রমত্তা চলনবিলের বুক চিরে ২০০২ সালে নির্মিত হয় ৫৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বনপাড়া-হাটিকুমরুল বঙ্গবন্ধু সেতু সংযোগ মহাসড়ক। সড়কটি চাটমোহর, তাড়াশ, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, উল্লাপাড়া ও রায়গঞ্জ উপজেলার মাঝ দিয়ে সোজাসুজি চলে গেছে। সড়কের দুই পাশে বিস্তীর্ণ চলনবিলের জলাশয়। সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুর; নাটোর জেলার গুরুদাসপুর, সিংড়া, বড়াইগ্রাম, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলা। পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে ধরা পড়া দেশীয় মাছকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে  শত শত অস্থায়ী শুঁটকির চাতাল। এসব চাতালে চলতি মৌসুমে প্রায় ২৪ কোটি টাকা মূল্যের ১০০ থেকে ১৫০ টন শুঁটকি উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।

নাটোর শহরের প্রবীণ লেখক খালিদ-বিন-জালাল বাচ্চু জানান, একটা সময় ছিল যখন চলনবিলের মাছ স্থানীয় অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলত। মাছ বিক্রি করেই আর্থিকভাবে সচ্ছল হয় এ অঞ্চলের মানুষ। ১৯১৪ সালে চলনবিলের মাঝ দিয়ে প্রথম ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মিত হয়। তখন চলনবিলের সঙ্গে কলকাতার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ওই সময় ট্রেনে করে মাছ যেত কলকাতায়। স্বাধীনতার পর চলনবিলের মাঝ দিয়ে বাঘাবাড়ী থেকে সিংড়া পর্যন্ত  নির্মিত হয় মুজিব বাঁধ। ২০০২ সালে চলবিলের বুক চিরে ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়ক নির্মাণ করা হয়। এ সড়কটি নির্মাণের পর চলনবিল এলাকার মানুষের জীবনে এনে দিয়েছে গতি। যোগাযোগ ব্যবস্থার এ উন্নতির প্রভাব পড়েছে চলনবিলের প্রতিটি গ্রামে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads