একটা সময় ছিল যখন আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জন সীমাবদ্ধ ছিল শুধু পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার উদ্দেশ্যেই। কিন্তু বর্তমানে দেশের তরুণরা নিজেদের গণ্ডিকে বিস্তৃত করেছে অনেকখানি। এখন শুধু ভালো নম্বর পাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই তাদের জ্ঞান অর্জন। এখন তরুণরাও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে চলেছে সমানতালে। উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তারা বের করছে চলমান অনেক সমস্যার সমাধান কিংবা এমন কোনো প্রযুক্তি যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে করে তুলছে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময়। আমাদের দেশের তরুণরা এখন লড়াই করছে বিশ্বের স্বনামধন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। ছিনিয়ে আনছে গৌরব। এ রকমই একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিযোগিতা হলো ‘ইউরোপিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জ ২০১৮’, সংক্ষেপে ইআরসি ২০১৮। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বানানো বিভিন্ন ধরনের রোভার নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলে এই প্রতিযোগিতার মঞ্চে। তাদের মধ্য থেকে বিচারকরা নির্বাচন করেন সেরা কিছু রোভার।
চলতি বছরের ১৪ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পোল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয় ইউরোপিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জ ২০১৮-এর ফাইনাল পর্ব। প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত রোভারদের মধ্য থেকে বিভিন্ন ধাপে বিচার প্রক্রিয়া শেষে ফাইনাল রাউন্ডে ২৫তম স্থান অর্জন করে নেয় রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘টিম অগ্রদূত’-এর উদ্ভাবিত একটি রোভার ‘মুক্তি’। টিম অগ্রদূতের অন্যতম সদস্যরা হলেন মো. মশিউর রহমান আকাশ, মিরাজ হোসেন আকাশ, সঞ্জয় দে, শাহরিয়ার রহমান ফাহিম, রাশিদুল হাসান, ইনিতেসার আহমেদ, তানভীর আহমেদ শান্ত ও মোহাম্মদ রাশিদুজ্জামান। এ ছাড়াও টিম অগ্রদূতের অ্যাডভাইজর হিসেবে ছিলেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান ড. রকুনুজ্জামান রানা, মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান ড. এমদাদুল হক এবং সহযোগী অধ্যাপক ড. সজল কুমার দাস।
রোভার ‘মুক্তি’র গল্পটি একটু পেছন থেকে শুরু করা যাক। মুক্তিকে নিয়ে টিম অগ্রদূত এ বছরের প্রথম দিকে অংশ নেয় ‘ইন্ডিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জ ২০১৮’তে। সেখানে কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন করায় আত্মবিশ্বাস ও অনুপ্রেরণা পান দলের প্রতিটি সদস্য। ফলে রোভারটিকে আরো উন্নত করে তারা অংশগ্রহণ করেন ইউরোপিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জ ২০১৮-এর মঞ্চে। বিভিন্ন ধাপে চলতে থেকে এর বিচার প্রক্রিয়া। মে মাসে আয়োজকদের নিকট একটি প্রিলিমিনারি রিপোর্ট পাঠায় টিম অগ্রদূত। প্রাথমিক ডিজাইন ও রোভারটি কীভাবে বানানো হবে তা উল্লেখ করা হয় এই রিপোর্টে। এরপর আগস্ট মাসে পাঠাতে হয় একটি ভিডিও রিপোর্ট, যেখানে উল্লেখ ছিল রোভারটি বানানোর প্রতিটি ধাপ। পরবর্তী সময়ে প্রিলিমিনারির আলোকে একটি ফাইনাল রিপোর্ট জমা দেওয়া হয় আয়োজকদের কাছে। সেখান থেকে তারা বাছাই প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচিত করেন সেরা ৬৫টি রোভার। এই ৬৫টি রোভার নিয়ে পোল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয় প্রতিযোগিতার ফাইনাল পর্ব এবং এতে ২৫তম স্থান অর্জন করে নেয় বাংলাদেশের রোভার ‘মুক্তি’।
রোভার ‘মুক্তি’ যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশে চলাচল করতে সক্ষম। এ ছাড়াও কোনো স্থানের মাটি সংগ্রহ ও বাতাসে গ্যাসের উপস্থিতি শনাক্ত করতে ব্যবহার করা যাবে এই রোভারটিকে। এতে ব্যবহার করা হয়েছে ‘সিক্স ডিগ্রি অফ ফ্রিডম’, যা এর রোবটিক হাতকে আরো মসৃণভাবে সঞ্চালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে এসবের বাইরে মুক্তির অনন্য একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি একটি স্বল্পমূল্যের রোবট এবং এটি বানাতে খরচ হয়েছে মাত্র ৪০-৫০ হাজার টাকা, যা অন্যান্য রোবটের তুলনায় অনেক কম। ভবিষ্যতে রোভার মুক্তিকে নিয়ে অনেক আশাবাদী টিম অগ্রদূত। অত্যাধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে রোভারটিকে আরো কর্মক্ষম করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। তারা স্বপ্ন দেখেন আগামী বছর ‘ইউরোপিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জ ২০১৯’-এ আরো ভালো একটি ফল অর্জন করে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করার।