সোনালুতে সোনালি রাজশাহী : প্রকৃতির ক্যানভাসে জীবন্ত চিত্রকলা
প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৪৬
-680862903c4ba.jpg)
ছবি : বাংলাদেশের খবর
গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে রাজশাহীর রাস্তাগুলো যেন সোনালি চাদরে মোড়া। গাছের পর গাছ ভরে উঠেছে ঝলমলে হলুদ ফুলে—প্রকৃতি যেন রংতুলি দিয়ে এঁকেছে এক জীবন্ত ছবি। এই মনোমুগ্ধকর ফুলের নাম সোনালু, যা স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘বাঁদর লাঠি’, ‘সোনাইল’ নামে পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম ‘ক্যাসিয়া ফিস্টুলা’। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের পাশাপাশি এই গাছের রয়েছে অসংখ্য ভেষজ গুণ, যা প্রাচীন আয়ুর্বেদ চিকিৎসা থেকে শুরু করে আধুনিক গবেষণায় উঠে এসেছে।
প্রকৃতির রূপান্তরের নাটক : শীতে মৃত্যু, গ্রীষ্মে প্রাণ
সোনালু গাছ প্রকৃতির এক অপূর্ব রহস্য। শীতকালে যখন গাছটি তার সমস্ত পাতা ঝরিয়ে ফেলে, তখন তাকে মৃতপ্রায় দেখায়। কিন্তু গ্রীষ্মের আগমনে পুনর্জীবনের মতো ফুটে ওঠে প্রথমে কচি পাতা, পরে ঝলমলে সোনালি ফুল। অল্প সময়ের মধ্যেই গাছটি ঢেকে যায় সোনার মতো ঝুলন্ত ফুলের মালায়। ফুলের মাঝেই দেখা যায় লম্বা সিলিন্ডারাকৃতির ফল, যা দেখতে অনেকটা লাঠির মতো—এই কারণেই একে ডাকা হয় ‘বাঁদর লাঠি’ নামে।
রাজশাহীর সড়কে সোনালুর সোনালি উৎসব
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) সৌন্দর্যবর্ধন কর্মসূচির অংশ হিসেবে শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে সোনালু গাছ রোপণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- বিমানবন্দর চত্বর থেকে বিহাস সড়ক (উভয় পাশে ১ কিলোমিটার জুড়ে সারিবদ্ধ সোনালু)
- কোর্ট স্টেশন থেকে কাশিয়াডাঙ্গা সড়ক
- ভেড়িপাড়া, পুলিশ লাইন, শাহমখদুম থানা সংলগ্ন সড়ক
- কোর্ট স্টেশন থেকে সিটি বাইপাস মোড় পর্যন্ত ফুটপাথের ধারে
২০১৯ ও ২০২০ সালে সামাজিক বন বিভাগ ও ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির সহায়তায় প্রায় ৬০০টি সোনালু গাছ লাগানো হয়। বর্তমানে এসব গাছ ৭-৮ মিটার উঁচু হয়ে উঠেছে এবং গ্রীষ্মের শুরুতেই ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে।
ভেষজ গুণে সমৃদ্ধ সোনালু
সোনালু গাছের সৌন্দর্যের পাশাপাশি রয়েছে একাধিক ভেষজ গুণ—
- ফল ও বাকলের রস কোষ্ঠকাঠিন্য, জ্বর ও লিভারের সমস্যা দূর করতে কার্যকর।
- ফুলের নির্যাস ব্যবহৃত হয় চর্মরোগ ও প্রদাহ নাশক হিসেবে।
- বীজে রয়েছে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান, যা সংক্রমণ রোধে সহায়ক।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সোনালুর পাতায় রয়েছে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ক্যান্সার প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখতে পারে।
নাগরিক প্রতিক্রিয়া
ভেড়িপাড়ার বাসিন্দা অভি বলেন, ‘ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে এমন সোনালু গাছের সমারোহ দেখা যায় না। রাজশাহীকে প্রকৃতির শহর হিসেবে গড়ে তুলতে আরও বেশি গাছ লাগানো উচিত।’
রাজশাহী কোর্ট স্টেশনের বাসিন্দা সোহাগ হোসেন বলেন, ‘আমি প্রতিদিন মোড়ে এসে চা খাই আর এই ফুল দেখি। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য মনে এক ধরনের প্রশান্তি এনে দেয়।’
মোড়ের চা ব্যবসায়ী মারুফ বলেন, ‘আমার দোকানের পাশে ৩-৪টা সোনালু গাছ রয়েছে। সবাই গাছের নিচে বসে চা খায়। ব্যবসাও ভালো হয়। সন্ধ্যাবেলায় যখন পাখিরা গাছে এসে বসে আর কিচিরমিচির করে—সেই দৃশ্য সত্যিই মন কেড়ে নেয়।’
নগরে সোনালুর সৌন্দর্যে দোলা দিচ্ছে এখানকার সর্বস্তরের মানুষের মনে। হলুদের আভায় মুগ্ধ হয়ে কেউ হয়তো আপন মনেই বলে—
‘সোনালুর রঙে সময় থেমে যায়—
পাঁপড়িতে ফুটে ওঠে
আদিম কোনো স্মৃতির ছায়া—
যখন পৃথিবী ছিল বর্ণ-গন্ধহীন,
আকাশ কেবল এক দীর্ঘ নিস্তব্ধতা।
আমি গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াই,
কোনো দূর চেতনার আভা ঢুকে যায় ভেতরে আমার
পলকহীন দৃষ্টির প্রবাহে।
আমার ছায়া গায়ে পরে নেয় হলুদ পোশাক—
আমি যেনো হয়ে উঠি ভুলে যাওয়া এক ঋতু।’
পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের আশ্রয়
রাজশাহী কলেজের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের প্রধান ড. মো. কামারুজ্জামান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘সোনালু গাছ পরিবেশবান্ধব এবং কম রক্ষণাবেক্ষণে টেকসই। এটি মাটি সংরক্ষণেও ভূমিকা রাখে।’ তিনি বলেন, এরা পাখি অভয়ারণ্যে হিসেবেও ভূমিকা রাখছে। সন্ধ্যা হলেই এই গাছগুলোতে পাখি এসে বসে। কী যে সুন্দর সেই মুহূর্ত, মন ভরে যায় এগুলো দেখলে।
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, বেশি বেশি পরিবেশ বান্ধব গাছ লাগানো হবে। শুধু সিটি করপোরেশন নয় সকলকে এগিয়ে আসতে হবে পরিবেশ রক্ষায় ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায়।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা : সোনালুর রাজ্য
রাসিকের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মকর্তা সৈয়দ মাহমুদ-উল-ইসলাম জানিয়েছেন, নগরীর প্রায় ৬০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম চলছে। সোনালুর পাশাপাশি আরও অনেক প্রায় বিলুপ্ত ফুল গাছ সংগ্রহ করে রক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নগরীর পার্ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তার ধারে এসব গাছ রোপণ ও পরিচর্যা করা হচ্ছে। রাসিকের নিজস্ব নার্সারিতেও সোনালুর চারা উৎপাদনের ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রশান্তির প্রতীক
সোনালু ফুলের এই স্বর্ণালি আভা শুধু রাজশাহীর সৌন্দর্যই বাড়ায়নি, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে করেছে আরও গভীর। শহুরে যান্ত্রিক জীবনের ক্লান্তির মাঝে এই ফুল এক টুকরো প্রশান্তির মতো। প্রকৃতি যেন বারবার মনে করিয়ে দেয়—সৌন্দর্য ঠিক কাছেই, একটু তাকালেই চোখে পড়ে।
রাজশাহীর এই সোনালু উৎসব যেন রঙে রঙিন এক ঋতুচিত্র—যেখানে প্রকৃতি, মানুষ ও প্রাণ একসঙ্গে মিলে তৈরি করে জীবনের এক অপূর্ব সিম্ফনি।
জেসি/এমএইচএস