Logo

রাজধানী

বিশৃঙ্খল গণপরিবহন

রেজাউল করিম হীরা

রেজাউল করিম হীরা

প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৫, ০৯:১৬

বিশৃঙ্খল গণপরিবহন

ছবি : বাংলাদেশের খবর

কোনোভাবেই শৃঙ্খলায় আনা সম্ভব হচ্ছে না রাজধানীর গণপরিবহন। আইনের তোয়াক্কা কেউ করছে না। রাস্তায় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ রহস্যজনক কারণে নিষ্ক্রিয়। তাদের সামনেই চলছে ফিটনেসবিহীন বাস ও মিনিবাস। আর বিশৃঙ্খলার জন্য সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার পাশাপাশি প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। 

অন্যদিকে ৫ আগস্টের পর পটপরিবর্তনে পরিবহন খাতের নেতৃত্বেও আসে হাতবদল। নতুন করে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দায়িত্ব নেয়। তারা বাস রুট রেশনালাইজেশনকে পাশ কাটিয়ে বিভিন্ন রুটে চলা বাসগুলো শৃঙ্খলায় আনতে রং এবং কাউন্টার চালুর উদ্যোগ নেয়। প্রথম রুট হিসেবে আবদুল্লাপুর হয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করা সব বাসের রং নির্ধারণ করা হয় গোলাপি। তবে আশার আলো জাগানো গোলাপি বাসও হতাশায় ডুবিয়েছে। 

রাজপথ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত অবৈধ অটোরিকশা ও থ্রি-হুইলার। পাশাপাশি নগরজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সাড়ে তিন হাজার অবৈধ বাস। গণপরিবহন সংকটে নগরজুড়ে ক্রমাগত বাড়ছে ব্যক্তিগত যানবাহনের সংখ্যা। এদিকে আয়তনের তুলনায় রাজধানীর সড়ক অপ্রতুল। রাস্তার এক-তৃতীয়াংশ অবৈধ দখলদারের কজায়। ফলে প্রতিনিয়ত নগরবাসী চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। 

এর আগে ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য সব অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের চলমান অভিযান জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে সে তৎপরতার প্রভাব সামান্য। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার মোট আয়তনের মাত্র ৭.৫ শতাংশ সড়ক। এর মধ্যে মাত্র ২.৫ শতাংশ রাস্তা গণপরিবহনের জন্য উপযুক্ত। সেখানেও অবাধে চলাচল করছে অবৈধ যানবাহন। এককথায় রাজধানীতে চলছে অনুমোদনহীন বাসের দৌরাত্ম্য। বিআরটিএ এবং পরিবহন খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

এদিকে স্বল্প সংখ্যক সড়ক অবৈধভাবে ব্যবহার করে চলছে দেশের বিভিন্ন জেলার বাস। দিনে রাতে সমানতালে এসব বাস সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আবার এসব আন্তঃজেলা বাসের কাউন্টার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন সড়কে। ঢাকার যানজট ও পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলার জন্য এসব কাউন্টার অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রামপুরা-কুড়িল বিশ্বরোড সড়ক, মিরপুর সড়ক, পান্থপথ সড়ক, কলাবাগানসহ রাজধানীর প্রতিটি সড়কে দিন ও রাতে সমানতালে চলাচল করছে বিভিন্ন জেলার আন্তঃজেলা বাস। এর মধ্যে রামপুরা-কুড়িল বিশ্বরোড সড়কে চলাচল করছে ইকোনো, আল বারাকা, লাল সবুজসহ অনেকগুলো আন্তঃজেলা বাস। যেগুলো চলাচল করছে লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী থেকে টঙ্গী পর্যন্ত।

একই রোডে চলাচল করছে চাঁদপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত আল আরাফাহ সার্ভিস। হামদান বাস খুলনা থেকে এই রুটে উত্তরবঙ্গে যাতায়াত করে। একই রুটে শেরপুর থেকে সাদিয়া বাস, চট্টগ্রাম থেকে টঙ্গী সোহাগ বাস চলাচল করছে। এই রুটে চলাচলকারী আন্তঃজেলা বাসগুলোর ১০-১২টি পয়েন্টে কাউন্টার রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টার্মিনালের বাইরে ঢাকার বিভিন্ন সড়ক ব্যবহার করে আন্তঃজেলা বাস চলাচলের অনুমতি নেই। এসব বাসের রুট পারমিটও বিআরটিএ দেয়নি। অবৈধভাবে চলছে আন্তঃজেলা ব্যসগুলো। এসব অবৈধ বাস নিয়ন্ত্রণে মামলাসহ আনুষঙ্গিক কাজ করার কথা পুলিশের। কিন্তু পুলিশের সামনে চলছে বাসগুলো। যেহেতু অবৈধ সে জন্য পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে, কিন্তু তারা নিচ্ছে না। 

এক সমীক্ষায় দেখা যায়, মাত্র ৪০ শতাংশ আন্তঃজেলা বাস বিদ্যমান তিন টার্মিনাল ব্যবহার করে। বাকি ৬০ শতাংশ বাস শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে পরিচালিত হয়। এগুলোই শহরের ভিতরে যানজট ও সড়কে বিশৃঙ্খলার অন্যতম কারণ।

এ বিষয়ে বুয়েটের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, পৃথিবীর উন্নত শহরগুলোর কোথাও আন্তঃজেলা বাস শহরের ভিতরে প্রবেশ করে না এসব বাসের টার্মিনালও থাকে শহরের বাইরে। তবে সেই টার্মিনাল ব্যবহার করা যাত্রীরা যেন শহরের বিভিন্ন প্রান্তে সহজেই পৌঁছতে পারে, সে জন্য রিং রোড, বাইপাস রোডের মতো ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ঢাকার চিত্রটি ঠিক উল্টো। এখানে শহরের ভিতরেই তিনটি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল। আবার আন্তঃজেলা বাসের একটা বড় অংশই পরিচালিত হয় টার্মিনালের বাইরে বিভিন্ন সড়কের ধার থেকে। এর মধ্যে চলছে বিভিন্ন অটোরিকশা। ফলে এগুলো যানজট ও পরিবহনখাতে বিশৃঙ্খলা দুটোই বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ঢাকা শহরের যে কোনো স্পটে দাঁড়িয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে, কী পরিমাণ অবৈধ যানবাহন ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে। আইন প্রয়োগে গাফিলতি ও ট্রাফিক পুলিশের দুর্নীতি রোধ করতে না পারলে কোনো দিনই সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না। যদিও সড়ক নির্মাণ ও অবকাঠামো খাতে বেশ পরিবর্তন এসেছে কিন্তু সে হিসাবে সড়ক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলায় কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাজধানীর শাহবাগ মোড় দিয়ে প্রতিদিন চলাচল করা এক হাজার ২২৫টি বাসের মধ্যে ৬৫৫টি অবৈধ। মতিঝিল দিয়ে চলাচল করা ৫৭৫টি বাসের মধ্যে ২৬২টি অবৈধ। আর বাড্ডা-রামপুরা, মোহাম্মদপুর-মিরপুর, যাত্রাবাড়ী দিয়ে চলাচল করা বেশির ভাগ বাসই অবৈধ। সদরঘাট থেকে নবীনগর রুটের সাভার পরিবহন লিমিটেডের ২০৪টি বাসের মধ্যে ১৩৭টি অবৈধ, ঘাটারচর থেকে সোনারগাঁ রুটের রজনীগন্ধা পরিবহন লিমিটেডের ১২২টি বাসের মধ্যে ১০৯টি অবৈধ, দিয়াবাড়ি থেকে পোস্তগোলা রুটের রাইসা এন্টারপ্রাইজের ২১১টি বাসের মধ্যে ১০০টি অবৈধ এবং নন্দন পার্ক থেকে চাষাড়া রুটের মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের ১৯৮টি বাসের মধ্যে ১৯৮টি অবৈধ। 

সূত্র জানায়, হাতিরঝিলে চক্রাকার বাস সার্ভিস ২০১৫ সালে চালু করা হয়। রামপুরা, তেজগাঁও, গুলশান ও বাড্ডায় সহজে যাতায়াতের জন্য ওই চক্রাকার বাসটি চালু করা হয়।

সব ঠিকঠাক চললেও জানুয়ারি থেকে হাতিরঝিল সড়কে চারটি কোম্পানির অবৈধ বাস চলাচল করছে। সেগুলো হলো প্রভাতী বনশ্রী, গাজীপুর পরিবহন, বলাকা ও আজমেরী গ্লোরী। ওই পরিবহনগুলো সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, সদরঘাট থেকে ছেড়ে রামপুরা, হাতিরঝিল হয়ে তেজগাঁও দিয়ে গাজীপুর চলে যায়। 

এদিকে দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকায় গণপরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা চলছে। আর এখন ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক সড়কে আতঙ্ক তৈরি করছে। দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মূল সড়কে তিন চাকার এই বাহন দুটির চলাচল বেড়েছে। পাশাপাশি প্যাডেলচালিত রিকশা তো রয়েছেই। দিন দিন সড়কে বেপরোয়া হয়ে উঠছে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক। লাইসেন্সবিহীন তিন চাকার ওসব পরিবহনের অলিগলি থেকে এখন প্রধান প্রধান সড়কেই আধিক্য বেশি। যদিও স্থানীয় সরকার আইন, ২০০৯ অনুযায়ী যেসব যান থেকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো কর আদায় করতে পারে বা নিবন্ধন দিতে পারে, সেই তালিকায় ব্যাটারিচালিত ওই বাহন নেই। তাতে সরকার যেমন বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি বাড়ছে নাগরিক ভোগান্তি। পাশাপাশি ব্যাটারিচালিত রিকশা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সীমিত সংখ্যক লাইসেন্সের বিপরীতে অনুমোদনহীন লাখ লাখ রিকশা এ নগরীতে চলছে।

এর আগে গত মাসে ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য সব অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের চলমান অভিযান জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়ন বিষয়ক বিশেষ সহকারী লে, জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঢাকা শহরের যানজট সহনীয় পর্যায়ে আনা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের লক্ষ্যে, গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ সভার বরাত দিয়ে এ তথ্য জানান। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনার আলোকে ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য সিটি করপোরেশনের অর্থায়নে আগামী ৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পাইলট আকারে ঢাকা শহরের চারটি ইন্টারসেকশনে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা স্থাপন করা হবে। এই পাইলটের ফলাফলের আলোকে আগামী চার মাসের মধ্যে আরও ১৮টি ইন্টারসেকশনে দেশীয় প্রযুক্তির ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা স্থাপন করা হবে।

বিকেপি/এমএইচএস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর