ইউনাইটেড হাসপাতাল
শিশু আয়ানের মৃত্যুর তদন্তে ধীরগতি
কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অবহেলা ও হুমকির অভিযোগ
সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া
প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ২১:৪৯
শিশু আয়ান
সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালের ভুল চিকিৎসায় গত বছরের ৭ জানুয়ারি মারা যায় পাঁচ বছরের শিশু আয়ান। আয়ানের মৃত্যুর খবর দেশ জুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ফলে নড়েচড়ে বসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
অভিযান চালায় রাজধানীর বাড্ডার সাতারকুল ইউনাইটেড হাসপাতালে। অভিযানে দেখা যায়, লাইসেন্স ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াই চলছিল হাসপাতালটির কার্যক্রম। হাসপাতালটির কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এ ঘটনায় আয়ানের বাবা শামীম আহমেদ অভিযুক্ত দুই চিকিৎসক ও অজ্ঞাতনামা কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে বাড্ডা থানায় একটি মামলা করেন। একইসাথে হাইকোর্টে ক্ষতিপূরণ চেয়ে একটি রিট দায়ের করেন। আয়ানের মৃত্যুর এক বছর পেরিয়ে গেলেও মামলার তদন্ত ও রিটের শুনানি কোনটি আশানুরূপ কোনো অগ্রগতি নেই।
মামলার অভিযোগ সূত্রে, ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি রাজধানীর ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ডাক্তার তাসনুভা মেহজাবিনের কাছে শামীম আহমেদ তার ছেলে আয়ানকে নিয়ে সুন্নতে খতনার বিষয়ে আলোচনা করতে যান। আলোচনা করে শিশু আয়ানের সুন্নতে খাতনা করার সময় চিকিৎসকরা আয়ানের বুকে হাত দিয়ে চাপা দেয় এবং বুকের দু’পাশে ছিদ্র করে টিউব স্থাপন করে। পরে আয়ানকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি রাত ১১ টা ২০ মিনিট পর্যন্ত লাইফ সাপোর্টে থাকার পর চিকিৎসকরা আয়ানকে মৃত ঘোষণা করে।
আয়ানের মৃত্যুর ঘটনা হাইকোর্টে
আয়ানের মৃত্যুর একদিন পর গত বছরের ৯ জানুয়ারি হাইকোর্টে স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করে জনস্বার্থে একটি রিট দায়ের করেন অ্যাডভোকেট এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম। রিটে আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়। একইসাথে আয়ানের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা চিকিৎসকদের সনদ বাতিল ও ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চাওয়া হয়। পরে শিশু আয়ানের বাবা রিটে পক্ষভুক্ত হন। নতুন করে রিটে পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়। তারপর হাইকোর্ট আয়ানের পরিবারকে কেনো পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না? তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। একইসাথে মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়।
নির্দিষ্ট সময় শেষে তদন্ত কমিটি ১৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দাখিল করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনকে "আইওয়াশ ও হাস্যকর" বলে উল্লেখ করে হাইকোর্ট। একইসাথে সুষ্ঠু তদন্তের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেন। সে কমিটির অন্যতম সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, আগস্টের পর দেশের পটপরিবর্তনের কারণে প্রতিবেদন দাখিলে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। আমাদের সাথে অ্যাটর্নি অফিস থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই আমরা তদন্ত প্রতিবেদন দিব। এদিকে রিটকারী আইনজীবী হাইকোর্টের রিটের পক্ষের আইনজীবী শাহাজাহান মাসুম আকন বলেন, হাইকোর্ট থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন চলতি মাসে দাখিল করার দিন ধার্য করা হয়েছে। আমরা আশাবাদী সত্য ঘটনা উঠে আসবে।
মামলার সবশেষ অবস্থা
আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলায় প্রথমে অভিযুক্ত দুইজন চিকিৎসক ইউনাইটেড হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের এনেসথেসিয়া স্পেশালিস্ট ডা. সাঈদ সাব্বির আহমেদ ও সহকারী অধ্যাপক ডা. তাসনুভা মেহজাবিন জামিনে রয়েছে। মামলায় পরবর্তীতে এই দুইজনসহ ইউনাইটেডর চিকিৎসক রিফাতুল আক্তার, গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম এডমিন) বসির আহমেদ মোল্লা, এজিএম এডমিন মঈনুল আহমেদ, ইউনাইটেড গ্রুপের হেলথ কেয়ারের পরিচালক নিজাম উদ্দিন হাসান রশিদ, ইউনাইটেড গ্রুপের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রেজা এবং ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈন উদ্দিন হাসান রশিদসহ নয়জনকে আসামি করতে আদালতে আবেদন করেন মামলার বাদি। বাড্ডা থানায় এই নয় আসামিকে মামলায় অর্ন্তভুক্ত করা হলেও তারা কেউ গ্রেপ্তার হয়নি কিংবা আদালতে আত্মসমপর্ণও করেনি। এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তাকে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। সরাসরি থানায় গিয়েও পাওয়া যায়নি তাকে।
তদন্ত বিলম্ব নিয়ে আয়ানের আইনজীবী পারভীন সুলতানা শাম্মী বলেন, ‘মামলার বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো এক বছরেও মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়নি। মামলার আসামি দুইজন চিকিৎসক জামিনে আছেন। তাদের বিদেশ যাত্রায় আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সবশেষ মামলাটির প্রতিবেদনের জন্য চলতি মাসের ২৭ জানুয়ারি ধার্য করা রয়েছে।’
আয়ানের বাবা মো. শামীম আহমেদ বলেন, ‘ইউনাইটেড হাসপাতালে আমার ছেলেটাকে এভাবে চোখের সামনে মারা গেল। হাসপাতালের স্বেচ্ছাচারিতা ও অবহেলার কারণে আমার সন্তান আয়ানকে অতিরিক্ত চেতনানাশক প্রয়োগ করিয়ে তার অকাল মৃত্যু ঘটানো হয়েছে। এটি জঘন্য অপরাধ। আমি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আমার সন্তানের মৃত্যুর জন্য দোষীদের শাস্তি চাই। ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের নানান সময়ে হুমকি দিচ্ছে আমরা জীবনের নিরাপত্তা চাই।’
এমআই