Logo

সারাদেশ

নারী দিবস

জন্মের পর থেকেই শুরু অদম্য জরিনার সংগ্রাম

Icon

জেলা প্রতিনিধি, বাগেরহাট

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২৫, ২৩:৫৮

জন্মের পর থেকেই শুরু অদম্য জরিনার সংগ্রাম

অন্ধকার থেকে আলোতে ফিরে আসার গল্প শুধু গল্পের বইয়েই সীমাবদ্ধ নয়; বাস্তব জীবনেও কেউ কেউ কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেন। বাগেরহাট সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের রহিমাবাদ গ্রামের জরিনা বেগম (৫৭) তেমনই এক নারী। চরম প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন।

একসময় যিনি অন্যের জমিতে দিনমজুরি করতেন, আজ তিনি নিজেই একজন উদ্যোক্তা। কিন্তু এই সাফল্যের পথ সহজ ছিল না; হৃদয়বিদারক কষ্ট ও সংগ্রামের পরেই এসেছে তার জীবনের এই পরিবর্তন।

জরিনা জন্ম এক অভাবী পরিবারে। ১২ ভাইবোনের মধ্যে বেড়ে উঠা দিয়েই কঠিন সংগ্রামের সূচনা। বাবার সামান্য আয়ে সংসার চলত না, তাই ছোটবেলা থেকেই তাকে নামতে হয় কঠোর পরিশ্রমের জীবনে। যখন অন্য শিশুরা স্কুলে যেত, তখন সাত বছর বয়সী জরিনা বাবার সঙ্গে মাঠে গিয়ে কাজ করতেন। কখনো ধান কুড়ানো, কখনো নদীতে মাছ ধরা এভাবেই তার শৈশব কেটেছে।

জরিনার সংগ্রামের শুরু এক হতদরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নিয়ে। ছোটবেলায় যখন অন্যরা স্কুলে যেত, তখন তিনি বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করতেন।  ১৯৮৫ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিয়ে হয়। বিয়ের পর জানতে পারেন স্বামী মাদকাসক্ত। প্রায়ই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন স্বামীর কাছে। তবুও সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সব সহ্য করেন। একপর্যায়ে জীবন বাঁচাতে তিন সন্তানকে নিয়ে পাড়ি জমান ঢাকায়- সেখানে গার্মেন্টসে কাজ শুরু করেন। প্রতিদিন সন্তানদের ঘরে রেখে কাজে যেতেন। মেয়ে বড় হলে একসময় সেও তার সঙ্গে কাজে যোগ দেয়।

কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে একটু স্বস্তি পেলেও দুঃখ তার পিছু ছাড়েনি। স্বামী অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসলেও কিছুদিন পরই অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে। তখন যা সঞ্চয় করেছিলেন, তার সবটুকু স্বামীর চিকিৎসায় ব্যয় হয়। এরপর একেবারে শূন্য হাতে ফেরেন গ্রামে। আবারও দিনমজুরির কাজে নেমে পড়েন মাটি কাটা, মাছ ধরা, রাজমিস্ত্রির সহকারী —যা কাজ পাওয়া যায় তাই করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বামীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

স্বামীর মৃত্যুতে দিশেহারা জরিনা তখন ব্র্যাকের ইউপিজি কর্মসূচির মাধ্যমে একটি ষাঁড় পান। সেখান থেকে তার জীবনের মোড় ঘুরতে থাকে। বেশ যত্ন নিয়েই গরুটি লালন-পালন করতে থাকেন। পরে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’-এ তার ঘর ভেঙে গেলে ব্র্যাক তাৎক্ষণিক সহায়তা দিয়ে টিন ও বাঁশের ব্যবস্থা করে দেয়। নিজেই ঘর মেরামত করেন। পাশাপাশি হাঁস-মুরগির খামার, ছাগল পালন, জৈব সার বিক্রি ও সবজি চাষ শুরু করেন।

বর্তমানে তার গরু, হাঁস-মুরগির খামার থেকে ভালো আয় হচ্ছে। আবার কৃষকদের কাছে সার বিক্রি করেও লাভবান হচ্ছেন। এখন আর তাকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হয় না। তিনি তার মেয়েকে ঢাকায় আর থাকতে দেন না, বরং বাড়িতে এনে নিজের গরুর খামারে কাজে লাগিয়ে দেন।

জরিনা বেগমের প্রতিবেশী ময়না আক্তার বলেন, রোজিনা আক্তারের পরিশ্রমের কাছে পুরুষ মানুষের পরিশ্রমও হার মানবে। গাছে ওঠা থেকে শুরু করে ধান রোয়া পর্যন্ত সবই পারেন তিনি। তাকে খাওয়ানোর মতো কেউ নেই। সরকার যদি তার সহযোগিতা করে তাহলে ভালোভাবে থাকতে পারতেন।

জরিনা বেগমের মেয়ে সুলতানা আক্তার বলেন, ‘ছোটবেলায় আমার মাকে অনেক নির্যাতন সইতে দেখেছি। আমার বাবা নির্যাতন করেছেন। তারপরও মা আমাদের নিয়ে সংসার করে গেছেন। আমার মা অনেক পরিশ্রম করেন। আশপাশের দশ গ্রামের কোনো নারী এত পরিশ্রম করতে পারবেন না।’

জরিনা বেগম বলেন, ‘সংসারের অভাবের তাড়নায়, নির্যাতনের কষ্টে কতবার ভেবেছি সব ছেড়ে দেব, কিন্তু আমার সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে হাল ছাড়িনি। আজ আমি কারও সাহায্যের মুখাপেক্ষী নই। আমার একটাই চাওয়া, আমার সন্তানরা যেন আর কষ্ট না করে, সুখে থাকে।’ 

তিনি বলেন, ‘৪০ বছর আগে জোর করে মো. ছোটন আমাকে বিয়ে করেন। দুই এক বছর সংসার ভালোই কেটেছিল, তারপর মারধর শুরু হয়। তিন ছেলেমেয়ে হলেও নির্যাতন কমেনি আমার উপর থেকে। নির্যাতন সইতে না পেরে ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টসে চাকরিও করেছি। ফুটপাতে মাছ, ডিমসহ শাক-সবজি বিক্রি করেছি। দুই বছর আগে স্বামীর মৃত্যু হলে বাড়িতে চলে আসি। বাড়িতে আসার পর মাথা গুজার ঠাঁই ছিল না; কোনোভাবে ঠাঁই হলো ছোট্ট একটি ঘরে। দুই মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলে বিয়ে করে সংসার নিয়ে থাকে আমার খোঁজ নেয় না। এক মেয়ে শ্বশুরবাড়ি আর এক মেয়েকে দেখতে হয় আমার।

জরিনা বেগমের জীবনসংগ্রাম প্রমাণ করে, যদি মনোবল দৃঢ় থাকে, তাহলে দারিদ্র্য, নির্যাতন বা কোনো বাধাই একজন নারীর অগ্রযাত্রা থামিয়ে রাখতে পারে না।

প্রান্তিক পর্যায়ের নারীদের ঘুরে দাঁড়াতে বাগেরহাটে কাজ করছে ইনিশিয়েটিভ ফর রাইট ভিউ, বাঁধন মানব উন্নয়ন সংস্থা, ওয়ার্ল্ড ভিশন, রুপান্তর, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। তাদের সহায়তা পেলে আরও অনেক জরিনার জীবন বদলে যেতে পারে।

শেখ আবু তালেব/ওএফ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর