৬ বছরেও শেষ হয়নি সেতুর কাজ, লাপাত্তা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান

বীরগঞ্জ (দিনাজপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৫, ১৭:৫৩

দিনাজপুরের বীরগঞ্জ ও খানসামা উপজেলার আত্রাই নদীর উপর নির্মিত জয়ন্তিয়া ঘাটের সেতু /ছবি : বাংলাদেশের খবর
দীর্ঘ ৬ বছরেও শেষ হয়নি আত্রাই নদীর দিনাজপুরের বীরগঞ্জ ও খানসামা উপজেলার জয়ন্তিয়া ঘাটের সেতু নির্মাণের কাজ। সেতুর কাজ না করেই এক বছর আগেই ‘লাপাত্তা’ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
জানা গেছে, ‘গ্রামীণ সড়কে গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় দুই উপজেলার লাখো মানুষের যাতায়াতের জন্য ২০১৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জয়ন্তীয়া ঘাটে ৪৪ কোটি ১৬ লাখে টাকা ব্যয়ে ৪৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতু নির্মাণ শুরু করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।
নির্মাণ কাজের জন্য দরপত্র আহ্বান করলে কাজটি পায় ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সুরমা কনস্ট্রাকশন। চুক্তি অনুযায়ী ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু পরপর দু’বার কাজের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হলেও কাজের অগ্রগতি মাত্র ৫৬ শতাংশ। অবশিষ্ট কাজ ফেলে রেখেই এক বছর আগে থেকে লাপাত্তা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ঠিকাদার ও এলজিইডির গাফিলতির কারণে সেতুর কাজ শেষ হচ্ছে না। জনগণের ভোগান্তি লাঘবে নির্মাণ শুরু করা এই সেতুর কাজ থমকে যাওয়ায় নদী পারাপারে জনগণের ভোগান্তি দূর হচ্ছে না। শুষ্ক মৌসুমে স্থানীয়দের ভরসা কাঠের তৈরি সাঁকো, যাতে চলাচলে দিতে হয় টোল। ঝুঁকি নিয়ে পারাপারে দুর্ভোগ-দুর্ঘটনা নিত্যসঙ্গী। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার কৃষি অর্থনীতি। আর বর্ষাকালে সবার ভরসা একটি নৌকা।
সরেজমিনে দেখা যায়, জয়ন্তীয়া ঘাট এলাকায় সেতুর সব পিলার স্থাপন হয়েছে। সেতুর পাঁচটি অংশের ৩টি স্প্যান ঢালাই হয়েছে। বাকি পিলার শুধু নদীর উপর দাঁড়িয়ে আছে। সেতুর নির্মাণ কাজে ব্যবহার হওয়া কিছু সামগ্রী, মালবাহী ট্রলি ও পাহারাদারদের রুম রয়েছে।
এখানে অলস সময় কাটাচ্ছেন কাজ শুরুর সময় থেকে নির্মাণ সামগ্রী দেখভালের দায়িত্বে থাকা দুজন পাহারাদার। নদীর পশ্চিমে মধুবনপুর, সনকা বাছার গ্রাম, ভোগডোমা, রাজিবপুর, রঘুনাথপুর ও ধুলোট গ্রাম। পূর্বদিকে খানসামা উপজেলার মধুবনপুর, নেউলা, দুহুশুহ, কায়েপুর, খামারপাড়া ও জোয়ার গ্রাম। উভয় পারের গ্রামে ৫০ হাজারের বেশি লোকের বসবাস।
স্থানীয়রা জানান, জনসাধারণ থেকে শুরু করে এ সাঁকো দিয়ে সাইকেল, রিকশাভ্যান ও ব্যাটারিচালিত চার্জারভ্যান জেলা পরিষদের মাধ্যমে ইজারা দেয়া এ খেয়াঘাট দিয়ে পারাপার হয়।
ভ্যানচালক আসাদুর রহমান বলেন, সেতু না হওয়ায় এই পথে যাত্রীর সংখ্যা অনেক কম হলেও জীবিকার তাগিদে অপেক্ষায় থাকতে হয়। সেতু হলে চলাচলেও যেমন পরিবর্তন আসবে তেমনি আয়-উপার্জনও বৃদ্ধি পাবে।
রোগী নিয়ে জরুরি সময়ে বিপাকের বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করে স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, এই সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার পর সন্তুষ্ট ছিলাম যে কাজটা হলে উপকার হবে। কিন্তু ৬ বছরেও কাজ শেষ হয়নি। বরং ঠিকাদারের লোকজন পালিয়ে গেছে এতে কাজ বন্ধ থাকায় আমাদের ভোগান্তি লাঘবে কারো নজর নেই।
ক্ষোভ প্রকাশ করে কাঁচামাল ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন বলেন, সেতুর অভাবে এই অঞ্চলের কৃষকদের কৃষি পণ্য পরিবহনে বাড়তি খরচ হয়। এতে পণ্যের ন্যাযমূল্য পাওয়া থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। সেতুর কাজ শেষ হলে কৃষি অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে। তাই দ্রুত সময়ে সেতুর কাজ করতে সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি প্রয়োজন।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালামালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পাহারাদার আব্দুল বাকী বলেন, ২০১৮ সাল সেতুর কাজ শুরুর সময় থেকে পাহারার জন্য চুক্তিতে দায়িত্বে আছি। শুরু থেকেই কাজের ধীরগতি ছিল। গত এক বছর থেকে কাজ পুরোপুরি বন্ধ।
তিনি আরও বলেন, সর্বশেষ ৬ মাস থেকে তারাও মাসিক বেতন পায় না। ঠিকাদারের সাথে যোগাযোগ করেও কোনো ফল আসেনি। তবুও বকেয়া পাওয়ার আশায় এখনো দুইজন পাহারা দিচ্ছি।
এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সুরমা এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কেউ কথা বলতে রাজি হয়নি।
পাল্টাপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. তহিদুল ইসলাম বলেন, এই সেতুর অভাবে দুই অঞ্চলের মানুষকে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার রাস্তা ঘুরে যেতে হয়। এতে কৃষি পণ্য পরিবহনে বাড়তি খরচ, রোগী ও জরুরি প্রয়োজনে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। তাই দ্রুত সময়ে সেতুর কাজ শেষ করে জনসাধারণের চলাচলের জন্য সেতু উন্মুক্ত করা প্রয়োজন।
দিনাজপুর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুর রহমান বলেন, জয়ন্তীয়া ঘাটে সেতু নির্মাণ কাজ শেষ করতে ইতোপূর্বে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কয়েকবার চিঠির মাধ্যমে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবুও কাজের অগ্রগতি হতাশাজনক। নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়াসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে কয়েক মাস থেকে কাজ বন্ধ হয়ে আছে। সেতু নির্মাণে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সুরমা এন্টারপ্রাইজের সাথে চুক্তি বাতিল করার প্রক্রিয়া চলছে।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে সুরমা এন্টারপ্রাইজের সাথে চুক্তি হওয়া চিরিরবন্দর উপজেলায় ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি সেতু নির্মাণ চুক্তি বাতিল করে পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
প্রদীপ রায় জিতু/ওএফ