Logo
Logo

সারাদেশ

কয়রায় হতদরিদ্রের চাল বিতরণে অনিয়ম, নিচ্ছেন মেম্বার-চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠরা

Icon

তরিকুল ইসলাম, খুলনা

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯:৫০

কয়রায় হতদরিদ্রের চাল বিতরণে অনিয়ম, নিচ্ছেন মেম্বার-চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠরা

মোছা. হামিদা বেগম। স্বামী শেখ নাজমুল ইসলাম চা-পান বিক্রেতা। তবে মাঝেমধ্যে শ্রমিকের কাজও করেন। স্বামীর ক্ষুদ্র আয়ে দুই মেয়ের পড়াশুনা খরচসহ পাঁচ সদস্যের পরিবার ঠিকমতো চলে না। হতদরিদ্রদের জন্য ভিডব্লিউবি চক্রের মাসিক ৩০ কেজি চাল পাওয়ার আশায় ২০২৩ সালে খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার আমাদী ইউনিয়ন পরিষদে আবেদন করেন। তবে তার আবেদন গৃহীত হয়নি বলে জানানো হয়।

বেশ কয়েকবার আমাদী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান জুয়েল ও স্থানীয় ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল আজিজের সাথে যোগাযোগ করেও কার্ড নিতে পারেননি তিনি। তার নামে ৩০ কেজি চালের কোনো কার্ড হয়নি বলে তারা তখন হামিদাকে জানান।

তবে আওয়ামী সরকার পতনের পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ভিডব্লিউবি চক্রের তালিকায় নাম রয়েছে তার। যদিও তিনি কখনও চাল পাননি।

হামিদা বলেন, আমাদের খুব কষ্টে জীবন গেছে। সংসদ নির্বাচনের কয়দিন আগে ওদের (সন্তান) আব্বুকে পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। তার কোনো অপরাধ ছিল না। মিথ্যা নাশকতা মামলায় চারমাস জেল খাটে। ওই সময় মেয়েটা খুবই অসুস্থ ছিল। তখন যদি এক বস্তা চাল পেতাম, মনে হয় বাচ্চা দুটোকে একটু ভালো রাখতে পারতাম। সংসার চালাতে লোকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছি। এখনও দুই সন্তান নিয়ে কষ্টে জীবনযাপন করছি।

একই ওয়ার্ডের নারগীস মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তার স্বামী প্রতিবন্ধী হওয়ায় তেমন কাজ করতে পারেন না। নারগীসের নামেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভিডব্লিউবি চক্রের একটি কার্ড রয়েছে। প্রতিমাসে চাল উত্তোলনও দেখানো হয়েছে। তবে নারগীস কোনো চাল পাননি বলে অভিযোগ করেন। এমনকি আবেদনের পরে তিনি মেম্বারের সাথে যোগাযোগ করলে তার নামে কার্ড হয়নি বলেও জানানো হয়। 

ফারজানা নামের এক স্বামী পরিত্যক্ত নারীও কার্ড থাকতে চাল পাচ্ছেন না । আট বছরের এক সন্তান নিয়ে তিনি কষ্টে দিনাতিপাত করেন। আবেদনের পরে একটি কার্ড পেলেও কখনও চাল উত্তোলন করতে পারেননি। স্বামীর নির্যাতনে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে জীবিকার তাগিদে ফারজানা সন্তান নিয়ে ঢাকায় চলে যান। সেখানে একটি গার্মেন্টসে কাজ করেন।

শুধু হামিদা, নারগীস কিংবা ফারজানা নয় কয়রা উপজেলার আমাদী ইউনিয়নের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তালিকা অনুসন্ধানে এমন বেশকজনের নাম পাওয়া গেছে। যাদের নামে কার্ড হলেও তাদেরকে চাল না দিয়ে প্রভাব খাটিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে স্থানীয় ইউপি সদস্য আত্মসাৎ করছেন কিংবা তার অনুসারী ব্যক্তিদের দিচ্ছেন বলে জানা যায়।  

অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার আমাদী ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৯ জন তালিকাভুক্ত হন। এরমধ্যে নাজমুন্নাহারের কার্ডের চাল তোলেন রহিমা খাতুন নামের একজন মহিলা, নারগীসের কার্ডের চাল নেন আঁখি বেগম নামের এক মহিলা, হামিদা বেগমের চাল নেন সোনিয়া বেগম, ফারজানার নামের কার্ডের চাল কে নেন তা জানা যায়নি।

এছাড়া ওই ইউনিয়নের কয়েকটি ওয়ার্ডের একাধিক প্রকৃত কার্ডধারীদের চাল না দিয়ে চেয়ারম্যান-মেম্বাররা প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের ঘনিষ্ঠজনদের দিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চালের কার্ডে প্রকৃত সুফলভোগীদের নাম লেখা থাকলেও সেটা কেটে দিয়ে অন্যদের নাম ঠিকানা লেখা হয়েছে। ১, ৩ ও ৫নং ওয়ার্ডের একাধিক প্রকৃত কার্ডধারীদের চাল দেয়া হয় না। তাদের কার্ড বাতিল করে নিজেদের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের নাম যুক্ত করা হয়েছে।

এছাড়া একাধিক সরকারি চাকরীজীবিসহ অধিক স্বচ্ছল পরিবার কার্ডের চাল পাচ্ছেন। ভিডব্লিউবি চক্রের তালিকাভুক্ত হতে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা নেয়া হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। 

২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল আজিজ সরদারের বিরুদ্ধে ১৮ নভেম্বর চাল আত্মসাতের অভিযোগ তুলে একই ওয়ার্ডের হামিদা ও নারগীস নামের দুই জন হতদরিদ্র মহিলা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। একমাস অতিবাহিত হলেও তাদের অভিযোগের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

হামিদার কার্ডের চাল উত্তোলনকারী সোনিয়া বেগম জানান, তিনিও আবেদন করেন। পরে ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম পুলিশ তাকে ফোন দিয়ে একটি কার্ড দেয়। সেখান থেকে প্রতিমাসে ফোন করার পরে চাল নেন। অন্যের কার্ড কিনা সেটা তিনি জানেন না। 

আমাদী ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল আজিজ বলেন, কার্ড বিতরণ করেন গ্রাম পুলিশ। সম্প্রতি বিষয়টি জানার পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি ভুলে একজনের কার্ড অন্যজনকে দেয়া হয়। এটা জানার পরে প্রকৃত কার্ডধারীকে চালের মূল্য এনে দিতে চেয়েছি। তবে তারা নিতে চাচ্ছেন না। তবে অন্যগুলো কীভাবে কী হলো তিনি জানেন না।

আমাদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান জুয়েল বলেন, দুই জনের অভিযোগ সম্পর্কে জেনেছি। তাদের কার্ড ভুলে অন্য দুইজনের কাছে চলে যায়। বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা চলছে।

তিনি আরও বলেন, বেশ কয়েকজন কার্ডধারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠায় তদন্ত সাপেক্ষ যথাযথ নিয়ম পালনের মাধ্যমে তাদের কার্ড বাতিল করে নতুনদের দেয়া হয়েছে। সেগুলো কর্তৃপক্ষ অবগত। দুই জনের অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের কাজ চলমান বলে জানান কয়রা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাস বলেন, একমাস আগে দুইজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন। বিষয়টি তদন্তের জন্য মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অন্য অভিযোগের বিষয়েও তদন্ত সাপেক্ষ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এমএইচএস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর