নওগাঁয় ৮২ ভাগ চালকল বন্ধ, বেকার ৩৫ হাজার শ্রমিক
নওগাঁ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪:৫৬
দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা নওগাঁয় একের পর এক বন্ধ হচ্ছে চালকল। অটো রাইস মিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ব্যবসা গোটাচ্ছেন এ খাতের বিনিয়োগকারীরা। ফলে কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন প্রায় ৩৫ হাজার শ্রমিক। বিশেষ করে চালকলে চাতালে জীবিকা নির্বাহ করা নারী শ্রমিকরা পড়েছেন বেশি বিপাকে।
সারা দেশের মোকামে ধান-চালের সিংহভাগ চাহিদা মেটায় উত্তরের জেলা নওগাঁ। আশির দশকে এ জেলায় গড়ে উঠেছিল ছোট-বড় ১ হাজার ৮০০-এরও অধিক হাসকিং মিল। বর্তমানে মিলগুলোর জীর্ণ দশা। অটোমেটিক রাইস মিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে জেলায় এ পর্যন্ত বন্ধ হয়েছে অন্তত ৮২ শতাংশ চালকল। যার প্রভাবে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী নিয়েছে চালের বাজারের নিয়ন্ত্রণ। বেকার হয়েছেন অন্তত ৩৫ হাজার চাতাল শ্রমিক। এ সংকট কাটাতে অন্তর্র্বতী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন চালকল মালিক গ্রুপের নেতারা।
সম্প্রতি সরেজমিন শহরের আড়ৎদারপট্টি-সুলতানপুর সড়কে গেলে দেখা যায়, দুই কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে অন্তত ৬টি হাসকিং মিল বন্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। শ্রমিকদের ব্যস্ততায় মুখর থাকা চালকলগুলোতে এখন সুনসান নীরবতা। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় মিলগুলো ছেয়েছে আগাছায়।
ওই এলাকায় পরিত্যক্ত এক হাসকিং মিলে প্লাস্টিক কারখানা গড়ে তুলেছেন সদর উপজেলার পার নওগাঁ মহল্লার সুমন সাহা। বিদেশে পড়াশোনা শেষ করে ২০১১ সালে বাবার মালিকানাধীন ৩টি হাসকিং মিলের ব্যবসার হাল ধরেছিলেন। মুনাফা থাকায় ব্যবসাও চলছিল বেশ। এরই মধ্যে ২০১৫ সালের পর অটোমেটিক রাইস মিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বড় অঙ্কের লোকসানের মুখে পড়তে হয় সুমন সাহাকে। পরে বাধ্য হয়ে দুটি হাসকিং মিল বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করেন।
সুমন সাহা বলেন, ‘অটোমেটিক রাইস মিল মালিকরা ব্যবসা শুরুর পর থেকে ধান চালের বাজারে তাদের একক আধিপত্য বিস্তার শুরু হতে থাকে। হাটে-বাজারে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ধান কেনা সম্ভব হচ্ছিল না। ওরা যেই দামেই ধান কিনুক না কেন, সেখান থেকে উৎপাদিত চাল বিক্রির সময় মোটা অঙ্কের টাকা লাভ করে সহজেই চাল বিক্রি করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘বিপরীতে হাসকিং মিলে উৎপাদিত চাল দেখতে আকর্ষণীয় না হওয়ায় বেশি দামে ধান কিনে সামান্য লাভ তো দূরের কথা, লাভ ছাড়া বিক্রি করতে গেলেও বাইরের মোকামের ব্যবসায়ীরা কিনতে চান না। এভাবে একটা পর্যায়ে নগদ টাকার সংকটে ঋণগ্রস্ত হয়ে ৩টি মিল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি।’
ভিমপুর এলাকার চাতাল শ্রমিক রহিমা, আমেনা ও সুফিয়া বলেন, ‘এক সময় সূর্যের আলো ওঠার আগেই দল বেঁধে চাতালে ছুটে আসতাম। খোলা কণ্ঠে গান গেয়ে পায়ে পা লাগিয়ে ধান শুকিয়েছি। পারিশ্রমিক হিসেবে চালসহ নগদ যে টাকা পেতাম, তা দিয়ে সংসার ভালোই চলত। কিন্তু এখন আর সেই সোনালি দিন নেই।’
চাতাল শ্রমিকদের সংগঠন নওগাঁ জেলা ধান ও বয়লার অটো শর্টার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোজাফফর হোসেন বলেন, ‘অল্প শ্রমিককে কাজে লাগিয়ে স্বল্প সময়ে বেশি পরিমাণে চাল উৎপাদনে সক্ষম অটোমেটিক রাইস মিল। বিপরীতে হাসকিং মিলে চাল উৎপাদনে বেশিসংখ্যক শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে। তাই একের পর এক হাসকিং মিল বন্ধ হওয়ায় চাতাল শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকা বর্তমানে চরম হুমকির মুখে পড়েছে।’
পাইকারি পর্যায়ের চাল ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অটোমেটিক রাইস মিলে উৎপাদিত পলিশকৃত চালে পুষ্টি গুণাগুণ কম হলেও ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদার শীর্ষে থাকে। তাই জেলার বাইরের মোকামে সরবরাহ করা ১১ লাখ টন চালের মধ্যে অন্তত ৮ লাখ টন চাল অটোমেটিক রাইস মিল মালিকদের থেকে নিতে হয়।
নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, ‘গত দেড় দশকে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই জেলায় অসংখ্য অটোমেটিক রাইস মিল গড়ে উঠেছে। মজুদ নীতিমালার তোয়াক্কা করেন না বেশিরভাগ অটোমেটিক রাইস মিলের মালিকরা। সরকার কখনোই তাদের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করেনি। যার প্রভাবে ৮২ শতাংশ চালকল মালিক ব্যবসা থেকে সটকে পড়েছেন।’
এম এ রাজ্জাক/এমজে