ছাত্রীনিবাসে থাকতে দেওয়া হয় না কাউকে
কলেজ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়
বাঘেরহাট প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৫
ছবি : বাংলাদেশের খবর
বাগেরহাটের সুন্দরবন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ শেখ খালিদ আহম্মেদের বিরুদ্ধে নিয়োগবাণিজ্য, জাল সনদে শিক্ষক নিয়োগ, আর্থিক অনিয়ম, এবং স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। প্রভাবশালী এই অধ্যক্ষের বিচারের দাবিতে সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতির বরাবর আবেদন করেছেন কলেজের শিক্ষকসহ স্থানীয়রা।
তারা বলছেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ খালিদ আহম্মেদ অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে কলেজের কোনো আয়-ব্যয়ের হিসাব দেন না। কোনো স্টক রেজিস্টারও নেই এই কলেজে। ২০২৪ সালে কলেজের বালি ভরাটের জন্য দেড় লক্ষাধিক টাকা উত্তোলন করলেও কোনো কাজ না করে পুরো টাকা মেরে দিয়েছেন তিনি।’
অভিযোগ রয়েছে, ‘২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে নামে-বেনামে প্রতিবছর মোটা অঙ্কের টাকা বরাদ্দ নেন অধ্যক্ষ। তবে এই অর্থ হিন্দু শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঠিকভাবে বণ্টন করেননি তিনি। এছাড়া টিউশন ফি’র টাকা শিক্ষকদের মাঝে বিতরণে অনিয়ম, উপবৃত্তি প্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে অর্থ কর্তন এবং বিশাল নিয়োগবাণিজ্যসহ কলেজের ২৭টি দোকানের ভাড়া উত্তোলন করে সেই অর্থ আত্মসাৎ করেছেন শেখ খালিদ।’
‘উপজেলা আওয়ামী লীগের পদে থাকা এবং তৎকালীন সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করেছেন শেখ খালিদ।’
এদিকে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও হোস্টেল সুপার জান্নাতুল মাওয়ার দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে প্রতিষ্ঠানটির ২১২ শয্যা বিশিষ্ট ৫তলা ছাত্রী নিবাসে কোনো ছাত্রী থাকতে পারেন না। ২০১৩ সালে স্থাপিত বিলাশ বহুল এই ভবনে শিক্ষার্থীরা না থাকলেও উপাধ্যক্ষ নাহিদুল ইসলাম ও তার স্ত্রী জান্নাতুল মাওয়া থাকেন। সম্প্রতি এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন স্ট্যাটাস লিখে নিন্দা জানাচ্ছেন স্থানীয়রা।
কলেজের শিক্ষার্থী জেরিন বলেন, ‘কলেজের অধ্যক্ষ স্যার নানা অনিয়ম করেন। এতবড় হোস্টেল থাকার পরেও শিক্ষার্থীদের থাকতে দেওয়া হয় না। তদন্তপূর্বক এসব অনিয়মের বিচার চাই।’
শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, ‘কয়েকদিন আগে দুইজন শিক্ষার্থী হোস্টেলে থাকার জন্য অধ্যক্ষের কাছে গেলে তিনি বলেন, এখানে থাকার পরিবেশ নেই। তোমরা অন্য ব্যবস্থা কর। অথচ হোস্টেলে শিক্ষার্থী থাকার সব ব্যবস্থা রয়েছে।’
কলেজের গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান বিষয়ের প্রভাষক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘নিয়োগবাণিজ্য করে অধ্যক্ষ লাখ লাখ টাকা কামিয়েছেন। তার এসব কাজে সহযোগিতা করেছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ, খুলনা অঞ্চলের পরিচালক হারুণ-অর-রশীদি এবং সহকারী পরিচালক মো. ইনামুল ইসলাম।’
নিয়োগ পেয়েও এমপিওভুক্ত হতে না পারা অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ফাহিমা খাতুন বলেন, ‘পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আবেদন করে, সকল নিয়ম মেনে আমরা চারজন এক সাথে নিয়োগ পেয়েছি। অধ্যক্ষ বড় অংকের টাকার বিনিময়ে ব্যাক ডেটে নিয়াগ দেখিয়ে দুইজনকে এমপিওভুক্ত করেছেন। আর আমাকে এবং দর্শন বিষয়ের আব্বাসের পদ শূন্য দেখিয়ে এনটিআরসিএর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। আমরা এই দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষের বিচার চাই এবং আমাদের এমপিওভুক্ত করার আবেদন জানাই।’
স্থানীয় বাসিন্দা ও মানবাধিকার কর্মী গোলাম মোস্তফা কামাল বলেন, ‘সাবেক সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক ও তার স্ত্রী সাবেক সংসদ সসদ্য হাবিবুন নাহারের ক্ষমতা পূজি করে নিয়োগবাণিজ্য, অর্থ কেলেঙ্কারী, স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা অনিয়ম করেছন অধ্যক্ষ। তদন্তপূর্বক এই অধ্যক্ষের বিচার দাবি করছি।’
হোস্টেলের বিষয়ে উপাধ্যক্ষ ইজারাদার নাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মোংলা ও ফকিরহাটে দুটি মহিলা কলেজ এবং যাতায়াত ব্যবস্থা ভাল হয়ে যাওয়ায় এখন শিক্ষার্থীরা হোস্টেলে থাকতে চায় না।’
তাহলে আপনারা স্বপরিবারে হোস্টেলে থাকেন কেন— এমন প্রশ্নে কোনো উত্তর দিতে পারেননি এই শিক্ষক।
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে অধ্যক্ষ শেখ খালিদ আহম্মেদ বলেন, ‘এসব অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই। মূলত আমাকে হেয় করার জন্য এসব অভিযোগ করা হচ্ছে। নতুন ভবনের পূর্বপাশে ও সামনে বালু ভরাট করা হয়েছে। টিউশিন ফির টাকা শিক্ষকদের দিতে হবে এমন কোনো আইন নেই।’
কলেজের নবনিযুক্ত সভাপতি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক কৃষিবিদ শামীমুর রহমান বলেন, ‘দলীয় দৃষ্টি থেকে নিয়োগবাণিজ্যের মাধ্যমে অনেক অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কলেজে লাইব্রেরি, ছাত্রীনিবাস ও মিলনায়তন বিষয়ে সমস্যা রয়েছে। বিশাল হোস্টেলে একজন ছাত্রীকেও থাকতে দেওয়া হয় না।কলেজের ২৭টি দোকানের ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। গরিব শিক্ষার্থীদের তহবিলের টাকাও লোপাট করা হয়েছে। সকল অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তদন্তে সত্যতা পেলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
শেখ আবু তালেব/এটিআর