ছবি : বাংলাদেশের খবর
কুমিল্লায় অবাধে মাটি কেটে ক্ষত-বিক্ষত করা হচ্ছে একসময়ের খরস্রোতা গোমতী নদী ও চর। শীত আসার পর পরই দুপাশের বাঁধ কেটে ওঠানামা করছে শত শত ট্রাক্টর। রাতদিন মাটিবাহী ট্রাক্টর চলাচলে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন নদীপাড়ের বাসিন্দারা। ধুলোয় বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ।
নদীর ভেতরের মাটি কাটার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে বাঁধ, সড়ক ও বেশ কিছু সেতু। জানা গেছে, জেলার অর্ধ শতাধিক ইটভাটায় এসব মাটি নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে গোমতী চরের মাটি কাটা প্রতিরোধে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন ভুক্তভোগী শত শত কৃষক। তারা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপিও প্রদান করেছেন।
জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডসূত্রে জানা গেছে, গোমতীর উৎপত্তিস্থল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুরে। এই নদীটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার কটকবাজার এলাকা দিয়ে। পরে জেলার আদর্শ সদর, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, দেবিদ্বার, মুরাদনগর, তিতাস ও দাউদকান্দি উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় গিয়ে মিশেছে। বাংলাদেশ অংশে এ নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৯০ কিলোমিটার।
দেবিদ্বার উপজেলার অংশের খলিলপুর, বিনাইপাড়, চরবাকর, বড় আলমপুর, চান্দপুর, লক্ষীপুর, কালিকাপুর-নয়াপাড়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শত শত ট্রাক্টর ছুটছে নদীর চরের দিকে, নদীর দুপাশে লাগামহীনভাবে কেটে নেওয়া হচ্ছে কৃষি জমির মাটি। রাতে ট্রাক্টরের শব্দ আর ধুলোয় অতিষ্ঠ গোমতীপাড়ের মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার আদর্শ সদর, দেবিদ্বার, মুরাদনগর, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, তিতাস অংশে অর্ধশতাধিক সিন্ডিকেট চক্র চরের সহজ-সরল কৃষকদের ফাঁদে ফেলে মাটি বিক্রি করতে বাধ্য করছে।
তারা চরের জমির মাটি কিনে ২০ থেকে ৪০ ফুট গভীর পর্যন্ত মাটি কেটে নেয়। পাশের জমিগুলো নিচে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিলে ওই সিন্ডিকেট পার্শ্ববর্তী জমির মালিককেও বাধ্য করেন মাটি বিক্রি করতে। নিরুপায় হয়ে নামমূল্যে মাটি বিক্রি করতে বাধ্য হন কৃষকরা।
সরেজমিনে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার টিক্কাচর, ছত্রখীল, পালপাড়া, দুর্গাপুর, আমতলী, কাচিয়াতলী, বুড়িচং এর বাবুবাজার, বাজেবাহেরচর এবং পূর্বহুরাসহ আশপাশের এলাকায়ও একই চিত্র দেখা গেছে। এসব এলাকায় বর্তমানে ফসল উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
মাটিকাটা চক্রের মূলহোতাদের মধ্যে রয়েছেন, দেবিদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জ এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম, কালিকাপুর-নয়াপাড়া এলাকার শিষন মিয়া ও দুলাল মিয়া। তারা রাতের আঁধারে মাটি কেটে ছুগুরা গ্রামের লিমা ব্রিকস ও কালিকাপুরের এমএমবি ব্রিকসে নিয়ে যান। একটি চক্র রাতে রাস্তায় বসে ম্যাজিস্ট্রেটের অভিযানের পাহারা দেন বলেও জানা গেছে। কুমিল্লা আর্দশ সদর এলাকা, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়ায় গিয়েও দেখা মিলেছে এই চিত্রের। এসব উপজেলার প্রায় শতাধিক ইটভাটায় গোমতীর চরের মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে।
দেবিদ্বার উপজেলার বড়আলমপুর গ্রামের (অব.) সার্জেন্ট নাছির বলেন, এক সময়ে এই চরে বিঘার পর বিঘায় চাষাবাদ হতো। বর্তমানে ফসল শূন্যে পুরো চর খাঁ খাঁ করছে। কয়েকদিন পর পর অভিযানে দু-একজন শ্রমিক আটক হলেও যারা মূল হোতা, তারা ধরে পড়ে না। তারা ধরা-ছোঁয়ার বাহিরে থেকে এসব পরিচালনা করে।
আদর্শ সদর উপজেলার টিক্কারচর এলাকার কৃষক মো. সিরাজুল ইসলাম ও আবু হানিফ, দেবিদ্বারের চরবাকর গ্রামের মনু মিয়া এবং খলিলপুর গ্রামের তোফাজ্জল হোসেন ও শরিফুল ইসলাম জানান, রাতে মাটি কাটা শুরু হয়, চলে ভোর পর্যন্ত। এই চরে সবজি ফলিয়ে রুটি রুজি করতেন এই এলাকার কৃষকরা, আজ তারা পথে বসেছে। জোর করে মাটি কেটে নিচ্ছে, বাঁধা দিলে মারধর করে। আগে আওয়ামী লীগের লোকেরা কাটত, এখন বিএনপির লোকেরা কাটে। গত বন্যায় পানি উঠে চরের ভেতরে বাড়িঘর ডুবে যায়, তখন নিরুপায় হয়ে বাঁধের ওপর আশ্রয় নেন তারা।
কয়েকমাস আগের বন্যায় গোমতী বেড়িবাঁধের অনেক স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। সহস্রাধিক মানুষ বস্তায় মাটি ভরে রাত-দিন বেড়িবাঁধের ভাঙনস্থানে সংস্কার করেছেন। পরে ২২ আগস্ট রাত ১০টার দিকে বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া এলাকায় বেড়িবাঁধ ভাঙন দেখা দেয়। এতে কুমিল্লার ৩টি উপজেলা প্লাবিত হয়। এত কিছুরপরও মাটি সিন্ডিকেটকে থামানো যাচ্ছে না। তারা শীত এলেই মাটি কাটা শুরু করে।
কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবদুল লতিফ বলেন, নদী হচ্ছে সরকারি সম্পত্তি। নদী থেকে বালু বা মাটি উত্তোলনের ঘটনায় জেলা প্রশাসক বা স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে পারেন, এটি তাদের এখতিয়ার। আমাদের দায়িত্ব হলো গোমতীর বেড়িবাঁধ রক্ষা। যদি কেউ বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত করে আমরা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করি। এখনো অনেক মামলা চলমান রয়েছে।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো.আমিরুল কায়ছার বলেন, গোমতী চরের মাটি কাটার বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি।
এটিআর/