মায়ের ভাষার বই চাই, শিক্ষক চাই : ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শিক্ষার্থী

মাল্টিমিডিয়া করেসপন্ডেন্ট, শেরপুর
প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:১৭

ছবি : বাংলাদেশের খবর
শেরপুর জেলায় গারো, কোচ, হাজং, বানাই, ডালুসহ সাতটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। এদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা। এসব পরিবারের সুখ-দুঃখের গল্পটা চলে মাতৃভাষাতেই। কিন্তু ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনতে হাঁটতে হয় বাংলা ভাষার হাল ধরে। তাই দিন দিন নিজ মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে, এতে আক্ষেপ তাদের। নিজস্ব ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা।
ঝিনাইগাতীর রাংটিয়া কোচ পাড়ার সোনে বিদ্যালয় এটি। এখানে প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। এমন অনেক বিদ্যালয় রয়েছে পাহাড়ি এলাকাগুলোতে। এসব বিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। কিন্তু নিজস্ব ভাষায় বর্ণপরিচয়, চর্চা ও লেখাপড়ার সুযোগ না থাকায় দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে তাদের মাতৃভাষা। শিক্ষার্থীরা চান নিজস্ব ভাষায় পড়তে ও সেই ভাষার শিক্ষক পেতে।
শিক্ষার্থী শুভশ্রী কোচ বলেন, আমরা স্কুলে বাংলা ভাষায় পড়ি। আমাদের ভাষা শেখানো হয় না। আমরা সরকারের কাছে আমাদের ভাষার বই ও শিক্ষক চাই।
গৌরব হাজং বলেন, আমাদের বাড়িতে হাজং ভাষায় কথা বলি। কিন্তু স্কুলে বাংলা ভাষা বলা লাগে। এতে আমাদের খুব সমস্যা হয়।
ষষ্ঠিনা কোচ বলেন, আমাদের স্কুলে কোচ ভাষায় পড়ানো হয় না। শুধু বাংলা পড়ানো হয়। তাই আমরা মায়ের ভাষা বলতেও পারি না, লিখতেও পারি না। আমরা চাই সরকার আমাদের ভাষার বই ও শিক্ষক দিক।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য নিজস্ব ভাষায় বই প্রকাশে ২০১০ সালে আইন প্রণীত হয়। সে মোতাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের জন্য ছয়টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভাষায় বই প্রণয়ন করে। সেগুলো হলো- চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল ও সাদ্রি ভাষা। তবে এসব ভাষার বই পড়ানোর জন্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি বিদ্যালয়গুলোতে। ফলে বইগুলো শিশুদের জন্য কোনো কাজেই আসছে না।
কোচ কালচারাল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক যুগল কিশোর কোচ বলেন, আমাদের ভাষার বই সরকার দিলেও তা পড়ানোর জন্য কোনো শিক্ষক দেয়নি। আমরা চাই আমাদের ভাষা টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হোক। প্রতিটি আদিবাসী এলাকার স্কুলেই বাংলা ভাষা পড়তে সমস্যা হয়। আমরা চাই পাহাড়ি এলাকায় আদিবাসী ভাষার শিক্ষক ও বই দেওয়া হোক। এতে করে আমাদের আদিবাসী ভাষা টিকে থাকবে।
শিক্ষক সংকটের কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসব ভাষার বই পড়ানো যাচ্ছে না। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার শিক্ষক না থাকায় সমস্যায় পড়ছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এতে বাংলা ভাষার সাথে শিক্ষার্থীদের পরিচিত করাতে অনেক সময় লাগে এবং শিক্ষকদের জন্যও কঠিন হয়ে পড়ে।
শিক্ষক হালিমা খাতুন বলেন, শিশু শ্রেণিতে আদিবাসী শিক্ষার্থী ভর্তি হলে ভাষাগত সমস্যার কারণে পড়ানো কঠিন হয়। তারা আমাদের ভাষা বুঝতে পারে না, আমরাও তাদের ভাষা বুঝি না। এজন্য তারা স্কুলে ভর্তি হতে অনিহা প্রকাশ করে।
শিক্ষক পারুল রানী বলেন, পাহাড়ি এলাকায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। তাদের পড়াতে ও বোঝাতে সমস্যা হয়। আমরা চাই, এসব স্কুলে তাদের মাতৃভাষার শিক্ষক নিয়োগ করা হোক। এতে শিক্ষার্থীরা স্কুলমুখী হবে এবং শিক্ষার হার বাড়বে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, শেরপুর জেলায় ২০ হাজার ৮৪০ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করছেন। এর মধ্যে গারো ৪৪ দশমিক ০২ শতাংশ, বর্মা জনগোষ্ঠীর ২৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ, কোচ ১০ দশমিক ২৪ শতাংশ, হোডি ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ, হাজং ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ, ডালু ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং অন্যান্য ০ দশমিক ৩৩ শতাংশের বসবাস।
ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশরাফুল আলম রাসেল বলেন, এ উপজেলাগুলোতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস বেশি। তাদের জীবনযাত্রার মতো ভাষারও বৈচিত্র্য রয়েছে। তারা পরিবারের সাথে নিজস্ব ভাষায় ভাব বিনিময় করে। এ ভাষাগুলো আমাদের ঐতিহ্য। সেগুলো সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং বাংলা একাডেমিসহ উচ্চ পর্যায়ের কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করা হবে।
শাহরিয়ার শাকির/এমবি