মুরগিকে ‘মুসলিম’ বানাতে চায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, সুবিধা নিচ্ছে আস্থা ফিড
প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৫, ২১:০৫

ফ্যাসিস্ট আমলে সরকারিভাবে ‘হারাম’ তকমা দিয়ে বিশ্বের একাধিক দেশ থেকে আমদানি নিষিদ্ধের পর প্রাণিজ প্রোটিন আমদানিতে দেশ-বিদেশে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নেয় আস্থা ফিড। প্রোটিন আমদানির মার্কেট এখনো সেই আস্থা ফিডের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। এই কারসাজির নেপথ্যের হোতারা (পতিত ফ্যাসিস্ট প্রধান হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ) গত ৫ আগস্টের পর দেশ ছেড়ে পালালেও আমদানি বাজারে আদৌ ভাঙেনি আস্থা ফিডের সিন্ডিকেট।
প্র্রাণিজ প্রোটিন বা মিট অ্যান্ড বোভাইন মিল (এমবিএম) আমদানির বিষয়ে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বলছেন, স্বৈরাচার সরকার প্রাণিজ প্রোটিন এমবিএম আমদানি নিষিদ্ধ করে আস্থা ফিডকে দেশি-বিদেশি মার্কেট দখলের সুযোগ করে দেয়।
আমদানির নামে এলসির মাধ্যমে ইউরোপ, আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে ফ্যাসিস্ট প্রধান ও এমপি-মন্ত্রীরা। শুধু তাই নয়, আস্থা ফিডের মালিকপক্ষও নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকা পাচার করছে।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদের দুবাইতে নির্মিত ১০০টি ভিলার মধ্যে ২০টি ভিলার নির্মাণ ব্যয়ও বহন করে আস্থা ফিডের ডিরেক্টর ও হাছান মাহমুদের ভাগিনা গিয়াস উদ্দিন। এছাড়াও শেখ হাসিনা থেকে শুরু অসংখ্য পলাতক নেতাদের বিদেশে পুনর্বাসনের জন্য আর্থিক জোগান দেওয়ার অভিযোগও উঠছে আস্থা ফিডের বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, আমদানি করা পোল্ট্রি খাদ্যে শুকরের হাঁড় মাংসের ব্যবহার করা হয় এমন অজুহাত দেখিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ২০১৮ সালে আমদানি নিষিদ্ধ করে ফ্যাসিস্ট সরকার। এতে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, কানাডা, ব্রাজিল ও ইউরোপ থেকে বোভাইন মিল আমদানি বন্ধে বাধ্য হয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। ধর্মের দোহাইও দেওয়া হয় সেসময়।
যদিও মুসলিম প্রধান দেশ পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়াসহ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও কমমূল্যে উন্নতমানের এমবিএম আমদানি করে আসছে। যে কারণে ওই দেশগুলোতে মুরগি, ডিম ও মাছের দামও তুলনামূলক কম। অথচ আস্থা ফিডের মাধ্যমে আমদানি করা এমবিএম বিক্রি হচ্ছে দেদারসে। মাছ, মুরগিকে ঠিকই খাওয়ানো হচ্ছে মিট অ্যান্ড বোভাইন মিল বা এমবিএম। কারসাজির মাধ্যমে শুধুমাত্র আস্থা ফিডকে সুযোগ দিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় চাহিদা থাকা স্বত্বেও পোলট্রি ব্যবসায় পড়েছে দৃশ্যমান নেতিবাচক প্রভাব।
এদিকে একচেটিয়া বাজার দখলের কারণে প্রোটিনের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় লোকসানের কবলে পড়ে খামারই বন্ধ করে দিচ্ছেন পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা। যে কারণে দেশের মাছ-মুরগি ও ডিমের দাম সবসময়ই উর্দ্ধমুখী।
ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে প্রতি বছর বোভাইন মিলের চাহিদা ৪২ হাজার মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য ২৪০ মিলিয়ন ডলার। দেশের সব আমদানিকারকরা আমদানি করতে পারলে এই চাহিদা যেমন সহজেই মেটানো যেতো, তেমনি বাজারেও এর নেতিবাচক প্রভাব কয়েকগুণ কমে আসতো।
আমদানিকারকদের একটি সূত্র জানায়, সাবেক সেনাপ্রধান শফিউদ্দিনের আত্মীয় ও হাছান মাহমুদের ভাগিনা গিয়াসউদ্দিন হাসানের ব্যবসায়িক সহযোগী মোশাররফ হোসেন চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর থেকেই এমবিএম আমদানিতে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করছে আস্থা ফিড। অন্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকেও এখন আস্থা ফিডের অনুমতিপত্র দেখিয়ে এমবিএম বিক্রি করতে হচ্ছে। রপ্তানিকারক দেশেও তাদের অনুমতিপত্র দেখাতে হচ্ছে। অন্যথায় আমদানির জন্য এমবিএম পাচ্ছেন না আমদানিকারকরা। ক্ষমতার কাছে কোণঠাসা ব্যবসায়ীরা গত প্রায় সাত বছর ধরে এমন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে আসছেন।
অথচ অভিযোগ রয়েছে, আস্থা ফিড শুল্কমুক্ত সুবিধায় নামমাত্র ভ্যাট দিয়ে কারখানার নামে এমবিএম আমদানি করে খোলা বাজারে বিক্রি করছে। যা সম্পূর্ণ বেআইনি বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘আমদানিকারক যদি বিদেশ থেকে ট্যাক্স সুবিধা নিয়ে র-মেটারিয়ালসে আমদানি করে বন্ডেড ওয়ার হাউজে না রেখে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেন তাহলে এটা একটা অপরাধ। তাছাড়াও তিনি যদি পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে আমদানি করেন তাহলে সেটাও একটা শাস্তি যোগ্য অপরাধ। যদি এর ব্যত্যয় ঘটে তাহলে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা গেছে, এমবিএম আমদানির আড়ালে মোশাররফ হোসেন চৌধুরী দুবাই, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে বিপুল টাকা বেনামি বিনিয়োগ করেছে। যার বৈধ উৎস নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। এমনকি তিনি নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামেও দুবাইতে ওয়েসিস ওভারসিস ও ইব্রাতাস ট্রেডিং কোম্পানি নামে একাধিক কোম্পানি খুলেছে। তার বোনের নামেও রয়েছে একাধিক কোম্পানি। ইতোমধ্যে তিনি দেশ থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা দুবাইতে পাচার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এমবিএমের জন্য সরকারের যতগুলো সার্টিফিকেশন থাকার দরকার আমরা তার সবগুলোই দিতে চেয়েছি। যেসব দেশ এমবিএম তৈরিতে কমপ্লায়েন্স মেনে কাজ করে আমরা তাদের থেকে সাপ্লাই নিলেও কোনো অসুবিধা ছিল না। কিন্তু তাতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কোনো সাড়া দেয়নি। তারা বলছেন, নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশ থেকে গবাদিপশু প্রোটিন আমদানির কারণে ব্যবসা কমে যাওয়ায় পাশাপাশি একচেটিয়া আধিপত্য ও বিশেষ সুবিধা আদায়ের ফলে প্রতি বছরে গড়ে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলারের বড় রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে সরকার।
ব্যবসায়ীরা বলেন, কিছু লোকের হাতে জিম্মি হয়ে গেছে এমবিএম আমদানি। তাদের মাধ্যমে সৌদি আরব ও দুবাই ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে ব্যবসা। তারা কিছুতেই চায় না এমবিএম ফিরে আসুক। তারাই একচেটিয়াভাবে ব্যবসা করছে। পাশাপাশি তারা এও বলেছে, মুসলিম দেশ ছাড়া এমবিএম আনা যাবে না। তাহলে হজে গেলে দেশের মানুষ আল ওতারির মুরগি খায় কীভাবে? তারাও তো বোভাইন মিল ব্যবহার করে। কিন্তু পতিত সরকার বাজার সংকুচিত করে দিয়ে গেছে। আমাদের দেশের কয়েকজন ব্যবসায়ী তাদের ওখানে বিনিয়োগ করে রেখেছে। যে কারণে তারা আর অন্য কাউকে সেখানে ব্যবসা করার সুযোগ দিচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০১৮-১৯ সালের দিকে আস্থা ফিডের চেয়ারম্যান মোশাররফ গবাদিপশু ও মাছের প্রোটিন আমদানির ক্ষেত্রে ধর্মকে ট্রাম্প কার্ড হিসেবে ব্যবহার করেন। যদিও মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তান এবং ব্রাজিল থেকে হালাল এমবিএম আমদানি করে আসছে। তবে রাজনৈতিক প্রভাব খাঁটিয়ে ও ব্যবসায় নিজের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে সাবেক সেনাপ্রধানের আত্মীয় পরিচয়ে, আস্থা ফিডের মোশাররফ ও সাবেক পররাষ্ট্র হাছান মাহমুদের ভাগিনা আস্থা ফিডের পরিচালক গিয়াসউদ্দীন সরকারের উচ্চ মহলকে ম্যানেজ করে ব্রাজিলসহ কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি করা নন বোনমিলকে হারাম ঘোষণা দিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছেন।
অন্যদিকে যেসব আমদানিকারক কোম্পানি ব্রাজিল, জার্মানিসহ উন্নত কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি করতেন তারাও এখন চরম বিপাকে পড়েছেন। বিষয়টি অনেকটা ব্রিটিশ আমলে এনফিল্ড রাইফেল ব্যবহার নিয়ে বাঙালি মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে যেমন মতভেদ তৈরি হয়েছে। ঠিক তেমন প্রেক্ষাপট তৈরি করে বাংলাদেশে এমবিএম আমদানি বন্ধ করে দেয়। যদি এমবিএম আমদানি করা যায় তাহলে প্রতি কেজিতে প্রায় ২টা কমে যেত। এতে বাজারে পোলট্রি মুরগি, ডিম ও মাছের দাম কমে যাবে।
এ ব্যাপারে মিট অ্যান্ড বোভাইন মিল ইন্ডাস্ট্রিজের অর্গানাইজিং সেক্রেটারি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘শুকরের মাংস মিশ্রিত হাঁড় ও বোন, গরুর মাংস মিশ্রিত হাঁড় ও বোভাইন মিল বলে পরিচিত। কিন্তু বাংলাদেশে মুরগি নাপাক খায় এই অজুহাতে বোভাইন মিল আমদানি বন্ধ করা হয় অযৌক্তিক কারণে। যদি দেশে বোভাইন মিল আমদানি করা সম্ভব হয় তাহলে ডিম, মুরগি ও মাছে দাম কমবে।
তিনি বলেন, সৌদি আরব বছরে ৫০ হাজার টন আমদানি করে, দুবাই প্রতিবছর প্রায় একই পরিমাণ মিটেন বোন আমদানি করে। এতে কী তাদের ধর্ম-কর্ম সব চলে গেলো? কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেন এটা করা হবে না। ২০১৮ সালে সরকারকে ভুল বুঝিয়ে কেউ বোভাইন মিল আমদানি বন্ধ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে অযৌক্তিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য আমরা দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সরকারি দপ্তরের কেউ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে চায় না। ওনারা বারবারই মুরগিকে মুসলমান বানানোর কাজ করছে’।
এসিআই’র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মিট অ্যান্ড বোভাইন মিল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, দেশি মুরগি ঘুরে ঘুরে যে খাবার টা খায় সেটা কি হালাল? মুরগি কি হালাল খাবে না হারাম খাবে সেটা নির্ধারণ কীভাবে করবেন? বাণিজ্য নীতিতেও এমবিএম আনা যাবে না এটা বলা নেই। অতিরিক্ত সচিব ওয়াসি উদ্দিন আহমেদ শুকরের মাংসের কারণে এমবিএম আমদানি বন্ধ করেন দেন। যদিও বাণিজ্য নীতিতে এমনটি বলা নেই। তখন আমরাও বিষয়টি মেনে নিয়েছি। শুকর বাদে এমবিএম আমদানি করব। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যদি শুকরের একটি কনাও আসে সেটা টেস্টে ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু এটাকে একটা ধর্মীয় বিষয় বানিয়ে ফেলেছে একটি চক্র। কয়েকজনের লোকে হাতে আমাদের এমবিএম জিম্মি হয়ে আছে। তাদের মাধ্যমে সৌদি আরব ও দুবাইয়ে ব্যবসা চলে গেছে। তারা কিছুতেই চায় না এমবিএম ফিরে আসুক।
এমবিএম আমদানিতে প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু সুফিয়ান বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে আমি অবগত নই। এটা নিষিদ্ধ আছে, এটুকু জানি। আমি ডিজির চেয়ারে বসেছি তিন মাস হলো, তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললেই ভালো হবে। এ বিষয়টি নিয়ে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তাকে ফোন করা হলেও তারা কথা এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
জানতে চেয়ে আস্থা ফিডের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন চৌধুরীকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও প্রতিউত্তর করেননি তিনি।