এলডিসি থেকে উত্তরণ : শিল্প খাতের চ্যালেঞ্জ ও বিসিআই’র কর সংস্কার প্রস্তাবনা

বাংলাদেশের প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৫, ১৬:০৫

বাংলাদেশ সরকার ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই উত্তরণ দেশের জন্য গর্বের হলেও অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে, বিশেষ করে রপ্তানি খাতের জন্য। এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য দেশের প্রদত্ত জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স (জিএসপি) সুবিধা হারাবে। এর ফলে রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপিত হবে, যা প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে, যাতে দেশীয় শিল্পের বিকাশ ও সেবা খাতের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হয়।
বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিসিআই’র প্রাক-বাজেট আলোচনায় এ প্রস্তাবনা উত্থাপন করা হয়।
শিল্প খাতে বিদ্যমান সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ
জ্বালানি সংকট : বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির উচ্চমূল্য উৎপাদন ব্যয় বাড়াচ্ছে।
এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি : অবকাঠামো উন্নয়নের ধীরগতি শিল্পায়ন ব্যাহত করছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি : কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।
ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ ব্যবসায়ীরা এসব কারণে বিপর্যস্ত। এ অবস্থায় বিসিআই একগুচ্ছ কর সংস্কার প্রস্তাবনা উত্থাপন করেছে, যা দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেবে এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করবে।
বিসিআই’র মূল প্রস্তাবনা
১. কর ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও সহজীকরণ
- কাস্টমস, মূসক ও আয়কর সংক্রান্ত বিধি-বিধান আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা।
- ব্যবসা ও করদাতা সহায়ক অবকাঠামো গড়ে তোলা।
- করনীতি, কর পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা সরল করা।
- কর পরিপালন হার বৃদ্ধি ও জিডিপিতে করের অনুপাত বাড়ানো।
- রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য কর সুবিধা নিশ্চিত করা।
২. সরবরাহ চেইনের শুল্ক ও কর নীতি সংস্কার
- নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও কাঁচামালের মূল্য স্থিতিশীল রাখা।
- আমদানি শুল্ক যৌক্তিক করা এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে করমুক্ত সুবিধা দেওয়া।
- শিল্প ও সেবা খাতের জন্য নির্দিষ্ট কর হারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।
- SME (ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প) খাতের কর ও ভ্যাটের হার যৌক্তিক করা।
৩. বিনিয়োগবান্ধব নীতি প্রণয়ন
- বিনিয়োগকারীদের জন্য সহজ শুল্ক-কর নীতি গ্রহণ।
- মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও শুল্ক-কর ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা।
- ট্রান্সফার প্রাইসিং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করা।
- ই-কমার্স ও প্রযুক্তি খাতে বিশেষ শুল্ক সুবিধা দেওয়া।
৪. কর ব্যবস্থায় সুষম অনুপাত নিশ্চিত করা
- বর্তমানে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ কর ও পরোক্ষ করের অনুপাত ৩৫:৬৫। বিসিআই এটি ৬৫:৩৫ হারে নামিয়ে আনার সুপারিশ করেছে, যাতে প্রত্যক্ষ করের অংশ বাড়ে এবং পরোক্ষ করের চাপ কমে।
- শিল্পায়নে কর সুবিধার সুপারিশ
- বিসিআই শিল্পের বিকাশে কিছু বিশেষ কর ও শুল্ক সুবিধা কার্যকর করার প্রস্তাব দিয়েছে:
মাইক্রো ও কুটির শিল্প (বার্ষিক টার্নওভার ১৫ কোটি টাকার নিচে)
- ৮ করমেয়াদ পর্যন্ত আয়কর অবকাশ।
- টার্নওভার ট্যাক্স মাত্র ১% নির্ধারণ।
- কাঁচামাল, মেশিনারিজ ও যন্ত্রপাতির আমদানিতে ১-৩% শুল্কহার।
ক্ষুদ্র শিল্প (টার্নওভার ৫০ কোটি টাকার নিচে)
- পণ্য খাতে ৩% ও সেবা খাতে ৫% রেয়াতি হারে মূসক।
- আমদানিকৃত কাঁচামালে ১-৩% শুল্কহার।
মাঝারি শিল্প (টার্নওভার ৩০০ কোটি টাকার নিচে)
- পণ্য খাতে ৪% ও সেবা খাতে ৫% মূসক।
- কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির আমদানিতে ১-৩% শুল্কহার।
বৃহৎ শিল্প (টার্নওভার ৩০০ কোটি টাকার বেশি)
- সাধারণ মূসক হার বজায় রাখা।
- আমদানিকৃত কাঁচামালের শুল্কহার ১-৩% রাখা।
- আয়কর সংস্কার প্রস্তাবনা
- ব্যক্তিগত করমুক্ত আয়ের সীমা ৫ লক্ষ টাকা করা (ভারতে ১২ লক্ষ রুপি)।
- প্রাইভেট কোম্পানির কর হার ২.৫% কমিয়ে ২৫% এবং পাবলিক কোম্পানির জন্য ২০% নির্ধারণ।
- রপ্তানি ও টেক্সটাইল খাতের বীমা দাবির কর হার ১০-১৫% নির্ধারণ।
- ব্যবসায় ক্ষতি হলে টার্নওভার কর বাতিল করা।
- সরবরাহ পর্যায়ে উৎসে কর হার ৫% থেকে কমিয়ে ৩% করা।
- সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পেনশন ফান্ড ও শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে কর আরোপ বাতিল।
বিশেষ কর সুবিধার সুপারিশ
- নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ কর সুবিধা নিশ্চিত করা।
- গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য করমুক্ত বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস সরবরাহ।
- ই-কমার্স ও ডিজিটাল সার্ভিসে কর ছাড় দেওয়া।
- বন্ডেড ওয়্যারহাউজ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
এএইচএস/এমজে