Logo

অর্থনীতি

বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট

বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনা

এম এ বাবর

এম এ বাবর

প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:২৮

বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনা

জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অর্থনৈতিক সংস্কার ও বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সোমবার থেকে শুরু হয়েছে ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট-২০২৫’। এ সামিটের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্ভাবনাগুলো তুলে ধরা হচ্ছে। পরিবর্তনশীল বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে রূপান্তরিত সময়ের সুযোগ এবং অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা কাজে লাগানোর ওপর আলো ফেলাই এই আয়োজনের উদ্দেশ্য। এ মাধ্যমে দেশের অর্থ-শিল্প ও বাণিজ্যের ব্যাপক উন্নয়নের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। 

এদিকে সোমবার থেকে এ সামিট শুরু হলেও আজ বুধবার সকালে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের স্টারলিঙ্কের স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হবে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য দূত ব্যারোনেস রোজি উইন্টারটন; ফিনল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট জার্নো সির্যালা; ডিপি ওয়ার্ল্ডের চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদ বিন সুলাইয়েম; ইন্ডিটেক্স গ্রুপের সিইও অস্কার গার্সিয়া মেসেইরাস; এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের উবারের পাবলিক পলিসি প্রধান মাইক অর্গিল; স্যামসাং সিঅ্যান্ডটির ভাইস প্রেসিডেন্ট কিয়ংসু লি; টেলিনর এশিয়ার এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড জন ওমুন্ড রেভহাগ এবং গিওর্দানো কোরিয়ার সিইও জুনসিওক হান। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) আয়োজনে চার দিনব্যাপী এই সম্মেলন শেষ হবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার। বিডা সূত্র জানায়, সামিটে  অংশ নিতে ৫০টি দেশের ২ হাজার ৩০০-এর বেশি বিনিয়োগকারী নিবন্ধন করেছিলেন। যার মধ্যে ৫৫০ জনের বেশি বিদেশি বিনিয়োগকারী রয়েছেন। 

শীর্ষ নিবন্ধিত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, সিঙ্গাপুর এবং জাপান। এছাড়া সামিটে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় করপোরেট ব্যক্তিত্বরা অংশ নেবেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন জারা গ্রুপের সিইও অস্কার গার্সিয়া মেসেইরাস, ডিপি ওয়ার্ল্ডের চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদ বিন সুলাইয়েম, ব্রিটিশ ব্যারোনেস রোজি উইন্টারটন, স্যামসাং সি অ্যান্ড টি-র ভাইস প্রেসিডেন্ট কিয়ংসু লি, গিওর্দানোর সিইও জুনসিওক হান, এক্সেলারেট এনার্জির প্রেসিডেন্ট স্টিভেন কোবোস, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের উবারের পাবলিক পলিসি প্রধান মাইক অর্গিল এবং মেটার পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর সারিম আজিজ। 

এ ছাড়া বি ক্যাপিটাল, গবি, কনজাংশন, মারুবেনি এবং জি এফ আরের মতো ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানগুলো স্টার্টআপ বিনিয়োগ ও ডিজিটাল অর্থনীতির প্রসারে কাজ করবে। এদিকে সামিটের অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে কোরিয়ান ইপিজেড ও মিরসরাইয়ে জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শনে যান চায়না কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৬০ জনেরও বেশি বিনিয়োগকারীর প্রতিনিধি দল। 

সামিটের প্রথম দিনই (সোমবার, ৭ এপ্রিল) সকাল ৯টায় আনোয়ারা কোরিয়ান ইকোনমিক জোনে জান তারা। এরপর কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থা, পুরো ইকোনমিক জোনের পরিবেশগত দিক, বিনিয়োগ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ ঘুরে দেখেন। ডেলিগেট টিমকে বাণিজ্য নগরীর বিপুল সম্ভাবনা, বন্দর ও অবকাঠামোগত সুবিধা তুলে ধরেন কোরিয়ান ইকনোমিক জোনের কর্মকর্তারা। চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেশি, বিদেশি বিনিয়োগের জন্য এমন উদ্যোগ এটিই প্রথম।

অন্যদিকে চীন, জাপান, সৌদি, যুক্তরাষ্ট্রসহ ৩৬ বিনিয়োগকারী নারায়ণগঞ্জের জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন করছেন। গতকাল মঙ্গলবার সকালে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বিএসইজেড এ আসে প্রতিনিধি দলটি। এ সময় তারা সুযোগ-সুবিধা ও কর্মপরিবেশ খতিয়ে দেখেন। এ দলে ছিলেন চীনের ১০ জন, যুক্তরাষ্ট্রের ৮, জাপানের ৩, সৌদি আরবের ৩, প্রবাসী বাংলাদেশি ৮ জনসহ ৩৬ জন।

শুরুতেই বিনিয়োগকারীদের সামনে বাংলাদেশ স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড (বিএসইজেড) কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগের বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাবনা তুলে ধরেন। এরপর তারা বিনিয়োগ পরিবেশ, পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ও অবকাঠামো বিষয়ক খোঁজখবর নেন। খতিয়ে দেখছেন সুযোগ-সুবিধা ও কর্মপরিবেশ। এ ছাড়া গতকাল বাংলাদেশ স্পেশাল ইকোনমিক জোনে সুইডিশ কোম্পানি নিলর্ন ১০ হাজার স্কয়ার মিটারের একটি প্লট নিয়েছে। এ বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। আয়োজকরা জানিয়েছেন, সুইডিশ এই কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশের বিনিয়োগে শুভ সূচনা হয়েছে। দিনভর ইকোনমিক জোন ঘুরে দেখেন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।

অন্যদিকে গতকাল ইয়াংওয়ান করপোরেশন চেয়ারম্যান কিহাক সাংয়ের নেতৃত্বে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারীদের একটি প্রতিনিধি দল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন। ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিহাক সাং চট্টগ্রামে কোরিয়ান ইপিজেডের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলাদেশে এককভাবে তিনি সর্বোচ্চ বিদেশি বিনিয়োগকারী। 

এদিকে স্টার্টআপ খাতের নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে বিশেষ তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশের যে সব তরুণের উদ্ভাবনী শক্তি আছে, নতুন ব্যবসা শুরুর দুর্দান্ত সব ধারণা আছে; কিন্তু প্রয়োজনীয় তহবিলের অভাব এবং সরকারের লাল ফিতার দৌরাত্মো নতুন উদ্যোক্তারা স্টার্টআপ ব্যবসা শুরু করতে পারে না— সেই সমস্যা কাটাতে বিনিয়োগের সম্মেলনে ঘোষণা এলো দেশি-বিদেশি স্টার্টআপ তহবিল গঠনের। 

সোমবার বিনিয়োগ সম্মেলনে ‘স্টার্টআপ কানেক্ট’ অধিবেশনে প্যানেল আলোচনায় স্টার্টআপ খাতের নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল করার ঘোষণা দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। এ বিষয়ে শিগগিরই একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। তিনি বলেন, সুযোগ দিলে দেশে বিকাশের মতো ১০টি ইউনিকর্ন বানানো সম্ভব। আমি বিকাশের মতো আরও কয়েকটি ইউনিকর্ন দেখতে চাই। বিকাশের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এটা করতে পারি। আমি আশা করি, আমাদের তরুণ প্রজন্ম হাল ছাড়বে না।

অন্যদিকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সুবিধা তুলে ধরেছে বিডা। গতকাল সকালে বেকোর সম্মেলন কক্ষে অর্থনৈতিক অঞ্চলটির নানাদিক তুলে ধরেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশ নেওয়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান ও অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিরা এ সময় পুরো এলাকা প্রদক্ষিণ করে দেখেন। তারা বিনিয়োগ পরিবেশ ও যোগাযোগ বয়বস্থা নিয়ে সন্তুষ্টিও প্রকাশ করেন। 

এই সময় তাদের কাছে পুরো এলাকার চিত্র তুলে ধরেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ করা বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা। ২০২২ সালে যাত্রা শুরু করা জাপানিজ ইকোনমিক জোনে হাজার একর জায়গার নানা অবকাঠামো উন্নয়নের চিত্র দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন তারা।

 বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, বিনিয়োগ প্যাকেজে যেসব সুবিধা বাংলাদেশ দেয়, তা অন্য যে কোনো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সক্ষম। তবে যে জায়গাটায় আমরা ব্যর্থ হই, বিনিয়োগকারী যখন আগ্রহ দেখায়, তারপর তাদের ল্যান্ড করানোর একটা প্রক্রিয়া আছে, তাকে আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যবোধটা দিতে হবে যে, আমরা যেটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, সে অনুযায়ী কাজ করতে পারব। এটাতে ব্যর্থ হই বলে অনেকে শেষমেশ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে না। তাই এই জায়গাটা আমাদের ঠিক করতে যে, আমরা যেন সরকার থেকে তাদের সহায়তা দিতে পারি, যাতে শেষ পর্যন্ত তারা বিনিয়োগ করেন। 

আশিক চৌধুরী আরও বলেন, ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদে আমরা এই বার্তাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি যে, সরকার থেকে আমরা সত্যিকার অর্থে সব লাল ফিতা দূর করার চেষ্টা করছি। স্টার্টআপ কমিউনিটিকেও আমরা একই রকম বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছি, যে আমরা শুধু ঢাকা-ভিত্তিক স্টার্টআপদের পাশেই নেই, আমরা সমগ্র দেশটাকে একেবারে তুলে আনতে চাই। ঢাকার বাইরের প্রকল্প বিনিয়োগকারীরা পরিদর্শন শেষে একটা আস্থা পাবেন। যদিও বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত একদিনে হয় না। উনারা বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তা করছেন, তাই বাংলাদেশে এসেছেন।

এই সফর করে কালকেই গিয়ে বিনিয়োগের চুক্তি সই করবেন, আমি এটাও মনে করি না। উনারা এখান থেকে একটা ইতিবাচক ধারণা নিয়ে ফেরত যাবেন, হেড অফিসে গিয়ে বলবেন ‘আমি জায়গাটা দেখে এসেছি, জায়গাটা কাজ করছে’। আমাদের কাজ হবে, যে ৬০-৭০ জন গিয়েছেন, তাদের পৃথকভাবে ট্র্যাক করব এখন থেকে। প্রত্যেকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব আগামী ৬ মাস, ১২ মাসে এটাকে বাস্তবিক বিনিয়োগে রূপান্তরিত করার জন্য।

১০ এপ্রিল সামিটে বিভিন্ন ব্রেকআউট সেশন অনুষ্ঠিত হবে। যার মধ্যে ডিজিটাল অর্থনীতি (সিটি এনএ ও ইউএনডিপি), টেক্সটাইল (এইচএসবিসি ও বিজিএমইএ), কৃষি ও কৃষি-প্রক্রিয়াজাতকরণ (ডাচদূতাবাস ও এলসিপি) এবং স্বাস্থ্যসেবা (ইন্সপিরা, ইবিএল ও সাজিদা ফাউন্ডেশন)-এর ওপর আলোচনা হবে। এ ছাড়া বিনিয়োগকারীদের জন্য ম্যাচমেকিং সেশন এবং সেরা বিনিয়োগ চর্চা নিয়ে রাউন্ড-টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

বিকেপি/এটিআর

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর