Logo

অর্থনীতি

ভিক্ষার টাকার চেয়েও কম ১৪ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর

আনোয়ার হোসাইন সোহেল

আনোয়ার হোসাইন সোহেল

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮:০১

ভিক্ষার টাকার চেয়েও কম ১৪ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর

পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুরবস্থা যেন কিছুতেই কাটছে না। দীর্ঘদিন ধরে পরিচালকদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থ লোপাটের কারণে এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন লাইফ সাপোর্টে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার গাফিলতি আর পরিচালনা পর্ষদের লাগামহীন দুর্নীতির কারণে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন দুর্নীতি নামক দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা গেছে, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে পুঁজিবাজারে আসা বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। শুরুতে হাতিঘোড়া দেখালেও এখন মিলছে অশ্বডিম্ব। প্রতিটি শেয়ারের ফেসভ্যালু যেখানে ছিল ১০ টাকা এখন সেগুলো দাম কমে দাঁড়িয়েছে ২ টাকায়। যেখানে এখন ভিক্ষুকদেরও দুই টাকা নিতে আপত্তি।

ডিএসই সূত্র জানায়, অন্তত ১৪টি কোম্পানির শেয়ারদর ফেসভ্যালুর নিচে রয়েছে। এগুলো হলো- পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস কোম্পানির প্রতিটি ১০ টাকার শেয়ার এখন (৪ ফেব্রুয়ারি) ২ টাকা ৩০ পয়সা। পিপলস লিজিং থেকে টাকা নিয়ে ফেরত না দেওয়া ১২৯ জনের মধ্যে বিদেশে পলাতক রয়েছেন পি কে হালদার। তিনি একাই পৃথক চারটি কোম্পানি ও নিজের নামে মোট ২৫৩ কোটি ৯৩ লাখ ৮৯ হাজার ৭৬৩ টাকা ঋণ নিয়েছেন। যার পুরোটাই এখন খেলাপি। ২০২১ সালের ২৮ জুন হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠানটি পুনরুজ্জীবিত বা পুনর্গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর থেকে প্রশাসক দিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি।

সাবেক সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) এম এ মান্নানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। ক্ষমতার অপব্যবহার, অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গকরণ, অসদাচরণ ও প্রতারণামূলকভাবে কাগজে প্রতিষ্ঠান মেসার্স টেলিকম সার্ভিস লিমিটেডের নামে ৮ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণ দেখিয়ে স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করার অভিযোগটির তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। 

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিআইএফসি ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর সালে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। সবশেষ তারা ২০১৩ সালে লভ্যাংশ দিয়েছিল। এছাড়া ২০১৪ সালে কোম্পানিটি রাইট আপ ইস্যু করে। সবশেষ (৪ ফেব্রুয়ারি) বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, এদিন কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ার দর নেমে দাঁড়িয়েছে ৭ টাকা ৫০ পয়সায়।

মেজর (অব.) মান্নানের নেওয়া ঋণ আদায় হয়েছে কিনা জানতে চাইলে বিআইএফসির কোম্পানি সেক্রেটারি আহসান উল্লাহ বাংলাদেশের খবরকে জানান, এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। 

বাজারে নেতিবাচক প্রভাবের পেছনে রয়েছে পরিচালকদের সীমাহীন লুটপাট ও আর্থিক অনিয়ম। মেজর মান্নানের নিয়ন্ত্রণে বিআইএফসির বিতরণ করা ঋণের ৯৭ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে। 

এছাড়া প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় ছিল, এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন খেলাপি ঋণের হার ৯৮ শতাংশের বেশি। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এ কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে।

এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে- জিএসপি ফাইন্যান্স কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড ৫ টাকা ৮০ পয়সা, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যানশিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড ৩ টাকা ৫০ পয়সা, ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পিএলসি ৯ টাকা ৪০ পয়সা, মাইডাস ফাইন্যান্স পিএলসি ৭ টাকা ৮০ পয়সা, ফনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ৩ টাকা ৯০ পয়সা, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেড ৪ টাকা ১০ পয়সা, ফাস (এফএএস) ফাইন্যান্স ৩ টাকা ৩০ পয়সা, ইউনিয়ন ফাইন্যান্স পিএলসি ৬ টাকা ৬২ পয়সা, প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ৩ টাকা ৫০ পয়সা। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২৬ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। গত জুন শেষে এই খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। ফলে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে ডিসেম্বরের শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা, যা ছিল ওই সময়ের মোট ঋণের ২৯ দশমিক ২৭ শতাংশ।

বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের নেতা আব্দুর রাজ্জাক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম রোধ করতে হলে ‘এনজিওগুলোকে আইডল’ হিসেবে দেখতে হবে। তারা ঋণ আদায় করতে পারলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান কেন ঋণ তুলতে পারছে না। এসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, এমডি ও কতিপয় কর্মকর্তার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো আজ আইসিইউতে। 

তিনি বলেন, পাশাপাশি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের ব্যর্থতাও অনেকাংশে দায়ী। কারণ তারা যদি কোম্পানিগুলো সঠিকভাবে মনিটরিং করতো তাহলে এমন দুর্দশা অবস্থা দেখতে হতো না। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার থেকে তাদের দেওয়া লোনের টাকা তুলছে পারছে না। যার অধিকাংশই এখন মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। ২০১০ সালের পর থেকেই তারা বিভিন্ন অনিয়ম ও কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে। যার সঠিক তদারকি হয়নি। যদি বিএসইসি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তারা সদিচ্ছা নিয়ে কাজ করে তাহলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়াবে। এখন ঋণ গ্রহিতাদের বুঝিয়ে ও মামলা করে টাকা উদ্ধার করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। পাশাপাশি নতুন করে যাতে কেউ দুর্নীতিতে জড়াতে না পারে সেজন্য এমডি ও চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের সজাগ থাকতে হবে।  

ডিএসইর সাবেক পরিচালক শরীফ আনোয়ার বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একদিনে এমন পরিস্থিতি আসেনি। গত ১৫ বছর একই অবস্থায় রয়েছে এগুলো। এখন এমন একটি পরিস্থিতিতে রয়েছি যেখানে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ অনিশ্চিত। কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুস বলেছেন, ‘আমরা একটা যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছি।’ রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত আমাদের এটা নিয়ে ধৈর্য ধরতে হবে। আমরা সিকিউরিটিজের কোম্পানি নিয়ে কাজ করি। বিনিয়োগকারী না থাকলে তো আমাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। আমরাও এসব সংকটের সমাধান চাই। যদিও বর্তমানে সেই পরিস্থিতি নেই। 

আইসিবির চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, লিজিং কোম্পানিগুলো ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীল। এখন অনেক ব্যাংকেরই দুর্বল অবস্থা। ফলে নিজেরাই নিজেদেরকে বাঁচাতে হবে। এখন অনেক কারখানা বন্ধ রয়েছে, কিন্তু সেগুলোর ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বহির্বিশ্বে মার্জার ও অ্যাকুইজিশনের ব্যবস্থা রাখে কিন্তু আমাদের এখানে নেই, যে কারণে খেলাপি দিন দিন বাড়ছে। এগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা কমছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে অবসায়নে পাঠাতে হবে। এছাড়া আপাতত আর কোনো উপায় দেখছি না।

  • এএইচএস/ওএফ
Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর