Logo
Logo

প্রবাস

ঋণ জালিয়াতি

যুক্তরাষ্ট্রে গোয়েন্দা নজরদারিতে বাংলাদেশি ২০ ব্যবসায়ী

অভিযুক্ত ৪, গ্রেপ্তার ২

Icon

নিউইয়র্ক প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫:২৭

যুক্তরাষ্ট্রে গোয়েন্দা নজরদারিতে বাংলাদেশি ২০ ব্যবসায়ী

যুক্তরাষ্ট্রে করোনা মহামারিতে প্রতারণার মাধ্যমে ভুয়া কর্মচারী দেখিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জরুরি ভিত্তিতে পে-চেক প্রটেকশন প্রোগ্রামের (পিপিপি) আওতায় যে ঋণ সুবিধা পেয়েছিলেন, তা ফেরত প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। 

ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভুয়া কর্মচারীর বিপরীতে পিপিপি লোন নিয়ে প্রচুর ব্যবসায়ী নিজেদের ব্যক্তিগত কাজে লাগিয়েছেন। লোনের অর্থ দিয়ে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি কেনার প্রতিযোগিতা করেছেন অনেক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী। 

এ ধরনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ২ বাংলাদেশি ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আরও ২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আর ফেডারেল গোয়েন্দাদের নজরদারিতে রয়েছেন আরও ২০ ব্যবসায়ী।

পিপিপি লোনের প্রায় আড়াই লাখ ডলার ঋণ নিয়ে বাড়ি কেনার অভিযোগ উঠেছে জ্যামাইকার বাসিন্দা হুমায়ূন কবির (৫৩) নামে এক উবার চালকের বিরুদ্ধে। পিপিপির অর্থ দিয়ে তিনি নায়াগ্রা জলপ্রপাত এলাকায় তিনটি বাড়ি কিনেছেন- এমন অভিযোগে মামলা করেছে কুইন্স ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি কার্যালয়।

মামলার খবর পেয়ে গত ২১ নভেম্বর কুইন্স কাউন্টির ১০৩ পুলিশ স্টেশনে আত্মসমর্পণ করেন উবারচালক হুমায়ূন। পরে তাকে কুইন্সের আদালতে হাজির করা হয়। আগামী ২৬ জানুয়ারি হাজিরা দেওয়ার শর্তে তাকে জামিন দিয়েছেন আদালত।

কুইন্স ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি মেলিন্ডা ক্যাটজ জানান, উবার ব্যবসায় ব্যাপক ক্ষতির শিকার হওয়ার কথা বলে হুমায়ূন কয়েক দফায় দুই লাখ ৪৬ হাজার ডলার ঋণ নেন। সেই অর্থ দিয়ে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের কাছে তিনি তিনটি বাড়ি কিনেছেন। এফবিআইসহ বিভিন্ন সংস্থার তদন্তের পর তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

মেলিন্ডা ক্যাটজ বলেন, ২০২০ সালের জুনে ইকনোমিক ইনজুরি ডিজাস্টার লোন (ইআইডিএল) পেতে ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রশাসনে (এসবিএ) আবেদন করেন হুমায়ূন কবির। সেখানে নিজেকে নিউইয়র্ক সিটির পরিবহন খাতের কর্মী হিসেবে বর্ণনা করেন। 

তখন ৫০ হাজার ১০০ ডলার ঋণ পান তিনি। এরপর ২০২১ সালের মার্চে পিপিপির জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রশাসনে আরেকটি আবেদন করেন হুমায়ূন। এ আবেদনে নিজেকে তিনি উবারচালক হিসেবে দেখান। এ দফায় তিনি ২০ হাজার ৮৩৩ ডলার ঋণ পান।

দুই মাস বাদে একই কর্মসূচি থেকে ঋণের জন্য ফের আবেদন করেন হুমায়ূন। তখন ক্ষুদ্র ঋণ প্রশাসন তাকে আরো ২০ হাজার ৮৩৩ ডলার ঋণ দেয়। এরপর আগস্টে ইকনোমিক ইনজুরি ডিজাস্টার লোনের পরিমাণ বাড়ানোর আবেদন করেন তিনি। 

তখন ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার ১০০ ডলার থেকে বাড়িয়ে এক লাখ ৫৫ হাজার ২০০ ডলার করা হয়। পরে আরেকবার বাড়িয়ে করা হয় দুই লাখ ৫ হাজার ৩০০ ডলার।

ঋণ নেওয়ার সময় হুমায়ূন কবির প্রত্যেকবারই অঙ্গীকারনামায় বলেন যে, ব্যাপক ক্ষতির শিকার ব্যবসাকে চাঙ্গা করতে ঋণের অর্থ ব্যয় করবেন।

এফবিআইসহ বিভিন্ন সংস্থা মাঠে নেমে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে, ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। অপকর্মের সহযোগিতাকারী সিপিএ ফার্মসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।

ঋণের অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করা হয়েছে কি না- তা খতিয়ে দেখতে গত বছরের মার্চ থেকে তদন্তে নামে নিউইয়র্ক স্টেট ফ্যাইন্যান্সিয়াল ডিপার্টমেন্টের গোয়েন্দারা। এফবিআইসহ অন্যান্য সংস্থাও এই তদন্তে শামিল হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনের সূত্র ধরেই উবারচালক হুময়িূনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে কুইন্স ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি কার্যালয়।

ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি মেলিন্ডা ক্যাটজ বলেন, এসবিএ থেকে নেওয়া মোট দুই লাখ ৪৬ হাজার ৯৬৬ ডলারের পুরোটাই বাড়ি কেনাতে ব্যয় করেছেন হুমায়ূন। বিষয়টি ব্যাংকের বিবরণীতে স্পষ্ট হয়েছে। হুমায়ূনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সেসব প্রমাণিত হলে তার ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। পাশাপাশি ‘প্রতারণামূলকভাবে’ তোলা অর্থও ফেরত দিতে হবে।

এর আগে, করোনা মহামারি পিপিপি লোনের প্রায় এক মিলিয়ন ঋণ নিয়ে জালিয়াতি ও প্রতারণার দায়ে নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে বাংলাদেশি নির্মাণ ঠিকাদার বাবা-ছেলে অভিযুক্ত হয়েছেন।

তারা হলেন, নিউইয়র্কে আঞ্চলিক সংগঠন সন্দ্বীপ সোসাইটির বর্তমান উপদেষ্টা নূরুস সাফা ও তার ছেলে মাইদা সাফা। 

মিথ্যা তথ্য দিয়ে লোন নিয়ে দুটি বাড়ি ও বিলাসবহুল বিএমডবিডব্লিউ গাড়ি কেনেন তারা। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি বর্তমানে ব্রকলিনের সিনিয়র সহকারী জেলা অ্যাটর্নি সের্গেই মার্টসের আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে এই মামলায় তাদের ১০ থেকে ২৫ বছরের সাজা হতে পারে।

এদিকে, গত ১৯ নভেম্বর সকালে নূর নবী চৌধুরী নামের এক বাংলাদেশি ব্যবাসায়ীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নিউইয়র্কে ব্রুকলিনে ফেডারেল আদালতে দুই বাংলাদেশি অভিযুক্ত হয়েছেন। তার ভাই মোহাম্মদ রহমান (৩৬) ঢাকায় থাকেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ‘২৪৭/টিভি স্ট্রিম’ নামে অবৈধ লাইভ স্ট্রিম চালাতেন। এর জন্য মাসিক ফি নিতেন। এর মধ্যে কপিরাইট ছাড়া লাইভ স্পোর্টস প্রোগ্রামিং ও বিভিন্ন টেলিভিশন শো প্রচার করত।

আদালতের নথি অনুযায়ী, আনুমানিক ২০১৭ সালের মে থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বরের মধ্যে আসামিরা অবৈধভাবে অনলাইন ভিডিও এবং স্পোর্টস স্ট্রিমিং দিয়ে আসছিল। প্রতি মাসে ১০ ডলারের মতো সাবস্ক্রিপশন ফিতে, গ্রাহকদের ইন্টারনেট-সংযুক্ত ডিভাইসে লাইভ টেলিভিশন ও স্পোর্টস প্রোগ্রামিং দেখাতেন।

অবৈধ ব্যবসা পরিচালনার জন্য অভিযুক্ত দুই ভাইয়ের ব্যবহৃত ওয়েবসাইট ডোমেনগুলো বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। সরকার কর্তৃক ‘টোয়েন্টি ফোর সেভেন টিভি স্ট্রিম ডটকম’ ভিজিট করলে সেখানে জব্দ করার নোটিশ দেখা যাচ্ছে।

নূর নবী চৌধুরী ও তার ভাই মোহাম্মদ রহমান কয়েক বছর ধরে এই অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। তারা এর মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে ৭০ লাখ ডলারের বেশি সাবস্ক্রিপশন ফি নিয়েছেন। 

অনুমান করা হচ্ছে, তাদের এই কর্মকাণ্ডের কারণে বৈধ কপিরাইটধারী মালিকদের ক্ষতির পরিমাণ ১০ কোটি ডলারের বেশি। আর এই কর্মকাণ্ডের জন্য তারা নিজেদের পরিচয় গোপন করে অন্য একজনের পরিচয় ব্যবহার করেন।

করোনা মহামারির পর প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিক খরচ বাবদ ফেডারেল সরকার পিপিপি ঋণ সুবিধা চালু করেন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু নানা অজুহাত দেখিয়ে ওই ঋণের অর্থ পরবর্তীকালে মওকুফ জন্য আবেদন করলে অনেকেই অর্থ মওকুফ পান। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে প্রতারণা করে নিউইয়র্কের বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের অনেকেই মিথ্যা তথ্য, বিশেষ করে ভুয়া অফিস ও কর্মচারী দেখিয়ে পিপিপি ঋণের অর্থে বাড়ি ও গাড়ি কিনেছেন, যা গুরুতর অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

ভূয়া অফিস ও কর্মী দেখিয়ে পিপিপি লোন নিয়ে অভিজাত বাড়ি ও বিলাসবহুল গাড়ি কিনে রাতারাতি সমাজসেবক হওয়ার খবর বাংলাদেশি কমিউনিটিতে নানা সময় আলোচনার খোরাক হয়েছে। অনেকে নিজের ব্যবসা গুটিয়ে অন্য ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। কেউ ব্যবসার মালিকানা পরিবর্তন করে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন। ফেডারেল গোয়েন্দাদের জালে তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে ধরা পড়েছেন। অনেকেই রয়েছেন গোয়েন্দা নজরদারিতে।

এমজে/ওএফ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর