Logo

খেলা

হামজা-সুনীল ম্যাচকে ঘিরে আকর্ষণ তুঙ্গে

Icon

বিবিসি

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৫, ০৮:১৮

হামজা-সুনীল ম্যাচকে ঘিরে আকর্ষণ তুঙ্গে

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ ঘিরে উত্তেজনা ও সোশ্যাল মিডিয়াতে দুই দেশের সমর্থকদের তর্কবিতর্ক বহুদিন হল একটা আলাদা উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। ফুটবল এতদিন তার ধারেকোছেও ছিল না।

কিন্তু মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) সন্ধ্যায় মেঘালয়ের রাজধানী, শৈলশহর শিলংয়ে দুই দেশের ফুটবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেও নতুন একটা ধারা যে তৈরি হতে যাচ্ছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই!

এদিন স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাতটায় এএফসি এশিয়ান কাপ কোয়ালিফায়ার পর্বের ম্যাচে মুখোমুখি হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল, যে ম্যাচটিকে ঘিরে উন্মাদনার পারদ দু'দেশেই উর্ধ্বমুখী।

এমনিতে ফিফার আন্তর্জাতিক র‍্যাঙ্কিংয়ে দুটো দলই 'লাস্ট বেঞ্চের ছাত্র' – ২১০টি দেশের মধ্যে ভারতের বর্তমান র‍্যাঙ্কিং ১২৬, আর বাংলাদেশের ১৮৫।

কাজেই বিশ্ব ফুটবলে নিচের সারির দুটো জাতীয় দলের ম্যাচকে ঘিরে আপাতদৃষ্টিতে তেমন কোনও হইচই হওয়ার কারণই ছিল না, অথচ হচ্ছে। যার কিছু কারণ ফুটবল সংক্রান্ত, কিছুটা আবার ফুটবলের বাইরেরও।

প্রথমত, এই ম্যাচের মধ্যে দিয়েই প্রথম বাংলাদেশের জার্সি পরে মাঠে নামছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ তারকা হামজা চৌধুরী – যেরকম আন্তর্জাতিক মাপের ফুটবলার এর আগে কখনও দক্ষিণ এশিয়ার কোনও দলের হয়ে কখনও খেলেননি।

সুতরাং হামজা চৌধুরীর যোগদান পুরো বাংলাদেশ টিমটার কাছে সমর্থকদের প্রত্যাশা এক লাফে অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে।

দ্বিতীয়ত, এই ম্যাচের ঠিক আগেই অবসর ভেঙে আবার জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তুলে নিয়েছেন ভারতের সফলতম ফুটবল অধিনায়ক ও সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক গোল স্কোরার সুনীল ছেত্রী।

৪০ পেরোনো সুনীল ছেত্রী গত বুধবার (১৯ মার্চ) ওই শিলংয়ের মাঠেই মালদ্বীপের বিরুদ্ধে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে 'কামব্যাক' করেছেন, নিজে গোল করেছেন এবং দলকে ৩-০ জেতানোর পেছনেও তার বড় ভূমিকা ছিল।

ফুটবল টিমগেম হতে পারে, তবে মঙ্গলবারের ম্যাচটাকে দু'দেশের অনেক সমর্থকই হামজা চৌধুরী বনাম সুনীল ছেত্রীর মোকাবিলা হিসেবেই দেখছেন।

তবে এসবের বাইরেও গত সাত-আট মাস ধরে ভারত ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে যে তীব্র উত্তেজনা চলছে, সেই রাজনীতিরও অবধারিত প্রভাব পড়েছে এই ফুটবল ম্যাচের ওপর। দুই দলের সমর্থকরাই রীতিমতো 'চার্জড' হয়ে আছেন।

তা ছাড়া মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই জোড়া ম্যাচ দিয়ে ভারতের আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাপে অভিষেক হচ্ছে শিলং-এর, ফলে সে কারণেও মেঘালয়ের স্থানীয় দর্শক ও ফুটবল অনুরাগীদের মধ্যেও আগ্রহ তুঙ্গে। বাংলাদেশ ম্যাচের টিকিটও বিক্রি হচ্ছে হু হু করে।

ফলে সব মিলিয়ে খুব অন্য রকমের এবং ব্যতিক্রমী একটা ভারত-বাংলাদেশ ফুটবল ম্যাচ মাঠে গড়াতে যাচ্ছে মঙ্গলবার সন্ধ্যায়।

কতটা কাজ করবে ‘হামজা ফ্যাক্টর’?
২৭ বছর বয়সী হামজা চৌধুরী চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রিমিয়ার লীগ ক্লাব লেস্টার সিটির হয়ে মোট ৫৭টি ম্যাচ খেলেছেন। জানুয়ারিতে 'লোনে' শেফিল্ড ইউনাইটেডে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ফক্সেস অ্যাকাডেমির এই গ্র্যাজুয়েটই ছিলেন বিগত দুই দশকের মধ্যে প্রিমিয়ার লীগে খেলা একমাত্র ব্রিটিশ এশিয়ান।

এখন বাংলাদেশি মায়ের সূত্রে তার বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলার সিদ্ধান্ত দলটার প্রোফাইল যে এক ধাক্কায় অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বাংলাদেশে এসে নামার পর থেকেই তাকে ঘিরে চলছে প্রবল মাতামাতি।

গত ২০ মার্চ ভারতের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে বাংলাদেশের ক্যাপ্টেন জামাল ভূঁইঞা এই কারণেই সাংবাদিক বৈঠকে বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছে যেন আমাদের মেসি এসে গেছে!’

জামাল ভূঁইঞা নিজে বাংলাদেশে এসেছেন ডেনমার্ক থেকে, কিন্তু তার বলতে কোনও দ্বিধা নেই, ‘আমি যখন প্রথম এসেছিলাম, তার চেয়ে উৎসাহটা এখন পাঁচ গুণ বেশি! হাজার হোক হামজা প্রিমিয়ার লীগ প্লেয়ার, এটা আমাদের মনোবল অনেক বাড়িয়ে দেবে।’

তবে একজন ফুটবলার পুরো দলের খেলার মান কতটা উন্নত করতে পারবেন, তা নিয়ে তর্ক আছে যথারীতি।

বাংলাদেশ ফুটবলকে হাতের তালুর মতোন চেনেন অস্কার ব্রুজন, যিনি এখন কলকাতার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে কোচিং করান। ব্রুজন আগে বাংলাদেশের জাতীয় দলের কোচ ছিলেন, বসুন্ধরা কিংস ক্লাবেও কোচিং করিয়েছেন বহুদিন।

তিনি টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেছেন, ‘প্রিমিয়ার লীগের একজন তারকা যখন আপনার দলে খেলে, দলের বাকিরাও কিন্তু নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দিতে উদ্বুদ্ধ হয়। তাই আমি বলব এখানে বাংলাদেশের অ্যাডভান্টেজটা হল মনস্তাত্ত্বিক।’

হামজা চৌধুরী সেন্টার ব্যাক বা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড পজিশনে খেলতে পারেন, তবে অস্কার ব্রুজনের ধারণা বাংলাদেশ তাকে বেশি করে সামনে এগিয়ে (ফরোয়ার্ড) খেলাতে চাইবে।

ব্রুজন আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ দলে কিন্তু শারীরিকভাবে শক্তসমর্থ বেশ কয়েকজন ফুটবলার আছে। তবে ওদের মাঝমাঠে কিছুটা সৃষ্টিশীলতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। এখন হামজা খেলাতে ওকে ঘিরে খেলার প্যাটার্নটা বদলানোর চেষ্টা হবে ধারণা করছি।’

হামজা চৌধুরী নিজে অবশ্য এর আগে বাংলাদেশে থাকতেই ভারতকে হারানোর হুমকি দিয়ে এসেছেন।

‘টু উইনস, টু ডার্বিজ। ইনশাল্লাহ্ উই উইল উইন, অ্যান্ড উই উইল প্রোগ্রেস!’, সিলেটে ভক্তদের কাছে কথা দিয়ে এসেছেন তিনি!

চল্লিশোর্ধ্ব সুনীল ছেত্রী কী করতে পারেন?

আধুনিক ভারতীয় ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকা ও লেজেন্ড হলেন সুনীল ছেত্রী, যিনি গত বছরের জুন মাসেই আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নিয়েছিলেন। অনেকেই মানেন, তার মাপের এত বড় গোল স্কোরার ভারতীয় ফুটবলে আর আসেনি।

ভারতের হয়ে ও দেশের বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে তার ২৬৮টি গোল আছে, যা একটি রেকর্ড। ১৫২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে তিনি গোল দিয়েছেন মোট ৯৫টি, যা সারা বিশ্বে চতুর্থ।

পর্তুগালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, ইরানের আলি দাইয়ি আর আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি ছাড়া নিজের দেশের হয়ে এত গোল আর কেউ করেননি। গত জুন মাসে বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে কুয়েতের বিরুদ্ধে ম্যাচের পরই তিনি অবসরের কথা ঘোষণা করেছিলেন, তার ঠিক দু'মাস পরেই চল্লিশ পূর্ণ করেন সুনীল ছেত্রী।

কিন্তু ভারতের বর্তমান কোচ মানোলো মার্কোয়েজ তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আবার জাতীয় দলের হয়ে খেলার জন্য রাজি করিয়েছেন।

মার্কোয়েজ বলেন, ‘এশিয়ান কাপ আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই টুর্নামেন্ট ও সামনের ম্যাচগুলোতে আমাদের ভাল করাটা খুব জরুরি, তাই আমি সুনীলের সঙ্গে কথা বলি। ও এলে আমাদের দল অনেক শক্তিশালী হবে, এটা বুঝেই ও ফিরতে রাজি হয়েছে।’

মালদ্বীপের বিরুদ্ধে প্রত্যাবর্তনের ম্যাচে নিজে গোল করে সুনীলও বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি এখনও ফুরিয়ে যাননি। ৭৬ মিনিটে দলের হয়ে তৃতীয় গোলটা করে রীতিমতো আবেগপ্রবণও হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তবে যতই অভিজ্ঞতা থাক, চল্লিশ পেরিয়ে যাওয়া একজন ফুটবলার শেষ পর্যন্ত মাঠে কতটা কী করতে পারবেন তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই।

ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচের আগে যে হামজা চৌধুরীকে নিয়ে এত আলোচনা, তিনি নিজেও কিন্তু সুনীল ছেত্রীকে বেশি সমীহ করতে চাননি।

হামজা বলেছেন, ‘ছেত্রীকে আমি খুব একটা বেশি দেখিনি। হ্যাঁ, ভারতের হয়ে ও প্রচুর খেলেছে, অনেক অভিজ্ঞতা। ও ভালো প্লেয়ার ঠিকই, কিন্তু আমি নিশ্চিত ওর চেয়েও ভালো অনেক প্লেয়ারের বিরুদ্ধেই খেলেছি। ‘আর হ্যাঁ, এটা কিন্তু হামজা বনাম ছেত্রী নয় – মনে রাখতে হবে এটা ভারত বনাম বাংলাদেশ!’

শিলং জুড়ে ফুটবল জ্বর
মঙ্গলবার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ম্যাচটা অনুষ্ঠিত হবে পাহাড়ি শহর শিলং-এর জহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে, যে মাঠটা ‘পোলো গ্রাউন্ড’ নামেই বেশি পরিচিত।

প্রায় তিরিশ হাজার দর্শক আসনের এই মাঠে ন্যূনতম টিকিটের দাম রাখা হয়েছিল মাত্র ১০০ রুপি, ফলে হু হু করে টিকিট বিক্রি হচ্ছে। রোববার বিকেলে ফোন করে জানা গেল, আর অল্প কিছু টিকিটই বাকি আছে।

সাতদিনের ব্যবধানে এই স্টেডিয়ামে দুটো আন্তর্জাতিক ম্যাচ হচ্ছে, অথচ শিলং-এ এর আগে কখনও ভারতের জাতীয় দল খেলেনি।

ভারতে ফুটবল সাংবাদিকতার পরিচিত মুখ রূপায়ন ভট্টাচার্যর কথায়, ‘শিলং আসলে এটা ডিজার্ভ করে। কারণ বাইচুং ভুটিয়া-পরবর্তী যুগে ভারতীয় ফুটবলে যে বিপ্লব ঘটে গেছে, তাতে সবচেয়ে বড় অবদান মণিপুরের, তার পরেই আসবে মেঘালয়ের নাম।’

ভট্টাচার্য বলেন,  ‘ওই রাজ্যের ফুটবল অবকাঠামোও বেশ ভাল। শিলং-এর স্টেডিয়ামটা যেমন শহরের একদম মাঝখানে, লোকজন খুব সহজে মাঠে আসতে পারেন। রাজ্যের কর্মকর্তারাও বেশ দক্ষ ও সৎ।’ 

মেঘালয়ের একটা সমৃদ্ধ ফুটবল সংস্কৃতি আছে বলেই ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ ঘিরে পরিবেশ এত জমজমাট হয়ে উঠেছে, এটা অনেকেই মানছেন।

ডাউকি সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের স্থলপথে শিলং আসাও বেশ সোজা – ফলে ভারত ভিসার কড়াকাড়ি শিথিল করলে হয়তো আরও বহু বাংলাদেশি সমর্থক এই ম্যাচ দেখতে শিলংয়ে আসতে পারতেন।

তবে গত ৫ অগাস্টের পর থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মিডিয়াতে সীমান্ত সংঘাত, সংখ্যালঘু নির্যাতন বা শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া-সহ নানা ইস্যুতে যে ধরনের পাল্টাপাল্টি 'প্রচারযুদ্ধ' চলছে, তারও একটা প্রভাব অবধারিতভাবে এই ম্যাচের ওপর পড়েছে।

রূপায়ণ ভট্টাচার্য বলেন, ‘হামজা চৌধুরী বা সুনীল ছেত্রী ছেড়েই দিলাম, ম্যাচটাকে ঘিরে এত আকর্ষণের প্রধান কারণ যে এই মুহূর্তের রাজনৈতিক পরিবেশ, তা তো বোঝাই যাচ্ছে!’

ডিআর/এমবি 

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর