৩ দেশে নজর
গাজাবাসীদের আফ্রিকায় পাঠানোর পরিকল্পনা ফাঁস

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ১৯:৫৫

ফিলিস্তিনের গাজা থেকে বাসিন্দাদের স্থায়ীভাবে আফ্রিকার কোনো একটি দেশে পাঠানোর চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। এই তালিকায় পূর্ব আফ্রিকার তিনটি দেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছে মার্কিন কর্মকর্তারা। যাতে গাজার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের পুনর্বাসনের জন্য তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করা যায়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত যুদ্ধ-পরবর্তী পরিকল্পনার আওতায় এই আলোচনা হয়েছে বলে মার্কিন ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) জানিয়েছেন।
পূর্ব আফ্রিকার সুদান, সোমালিয়া ও সোমালিয়ার বিচ্ছিন্ন অঞ্চল সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে আলোচনা করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এসব দেশের সাথে আলোচনা প্রমাণ করে যে ট্রাম্প গাজাবাসীদের স্থায়ীভাবে সরিয়ে দিতে চান। ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ব্যাপক নিন্দার মুখে পড়েছে এবং গুরুতর আইনি ও নৈতিক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে।
এই তিনটি দেশই দারিদ্র্যপীড়িত। দেশগুলোর বিভিন্নস্থানে গৃহযুদ্ধ চলছে। ফলে ট্রাম্পের ঘোষিত লক্ষ্য— গাজার ফিলিস্তিনিদের ‘একটি সুন্দর স্থানে’ পুনর্বাসন—এই পরিকল্পনার বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করেছে।
সুদানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর সোমালিয়া ও সোমালিল্যান্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে তারা এমন কোনো আলোচনার বিষয়ে অবগত নন।
ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজার ২০ লাখেরও বেশি মানুষকে স্থায়ীভাবে অন্যত্র পাঠানো হবে। তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্র গাজার নিয়ন্ত্রণ নেবে। দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে পুনর্গঠনের কাজ পরিচালনা করবে। এটিকে একটি রিয়েল এস্টেট প্রকল্প হিসেবে গড়ে তুলবে।
এক সময় ইসরায়েলের কট্টর জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর কল্পনা বলে মনে করা হলেও, গত মাসে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প এই ধারণা উপস্থাপন করেন। এ সময় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এটিকে ‘সাহসী দৃষ্টিভঙ্গি’ বলে প্রশংসা করেছেন।
গাজার ফিলিস্তিনিরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইসরায়েলের ‘স্বেচ্ছায় স্থানান্তর’ দাবিকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও কঠোরভাবে এর বিরোধিতা করেছে। দেশগুলো একটি বিকল্প পুনর্গঠনের পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে, যা ফিলিস্তিনিদের তাদের নিজ ভূমিতেই রাখার পক্ষে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা আন্তর্জাতিক আইনে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবুও হোয়াইট হাউস বলেছে যে ট্রাম্প তার ‘পরিকল্পনার প্রতি অবিচল’ রয়েছেন।
গোপন কূটনৈতিক যোগাযোগ
নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে মার্কিন ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা কূটনৈতিক যোগাযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তারা সোমালিয়া ও সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে আলোচনা বিষয়ে জানিয়েছেন। আর মার্কিন কর্মকর্তারা সুদানের সঙ্গেও যোগাযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে আলোচনায় কতটা অগ্রগতি হয়েছে বা আলোচনা কী স্তরে পরিচালিত হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।
মার্কিন কর্মকর্তাদের মতে, ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করার কয়েকদিন পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এই তিনটি সম্ভাব্য গন্তব্যস্থলের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে যোগাযোগ শুরু করে।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র এই দেশগুলোর কাছে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন লোভনীয় প্রস্তাব দিতে পারে। ট্রাম্প এর আগেও ২০২০ সালে আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে চারটি আরব দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সমঝোতা করিয়েছিলেন।
তবে, হোয়াইট হাউস নতুন এই আলোচনার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
নেতানিয়াহুর দপ্তর ও ইসরায়েলের মন্ত্রিসভার সদস্য রন ডারমার, যিনি যুদ্ধ-পরবর্তী পরিকল্পনার নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারাও কোনো মন্তব্য করেননি।
কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনিদের কথিত ‘স্বেচ্ছায়’ দেশত্যাগের সমর্থক ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচ বলেছেন, ইসরায়েল এখন দেশগুলোর সন্ধান করছে, যারা ফিলিস্তিনিদের গ্রহণ করতে পারে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘বৃহৎ অভিবাসন বিভাগ’ গঠনের প্রস্তুতি চলছে।
তিনটি সম্ভাব্য গন্তব্যস্থল
সুদান
উত্তর আফ্রিকার দেশ সুদান ২০২০ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আব্রাহাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। চুক্তির অংশ হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্র সুদানকে সন্ত্রাসবাদের মদদদাতা রাষ্ট্রের তালিকা থেকে সরিয়ে দেয়। যা দেশটির জন্য আন্তর্জাতিক ঋণ এবং বৈশ্বিক স্বীকৃতির সুযোগ করে দেয়।
তবে সুদান সরকার ও আধাসামরিক বাহিনী আরএসএফের মধ্যে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক এগোয়নি। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এই সংঘাত জাতিগত নিধন, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী।
এ রকম একটি দেশে ফিলিস্তিনের পাঠানো যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের জন্য খুবই কঠিন বিষয়। কিন্তু তারা খার্তুম সরকারকে ঋণমুক্তি, অস্ত্র, প্রযুক্তি ও কূটনৈতিক সহায়তাসহ প্রণোদনার আশ্বাস দিতে পারে।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে দুই সুদানি কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন যে ট্রাম্প প্রশাসন সামরিক নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের গ্রহণ করার বিষয়ে আলোচনা করেছিল।
একজন সুদানি কর্মকর্তা বলেন, ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের আগেই যোগাযোগ শুরু হয়েছিল। আরএসএফের বিরুদ্ধে সামরিক সহায়তা, যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠনে সহায়তা ও অন্যান্য প্রণোদনার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
উভয় কর্মকর্তাই নিশ্চিত করেন সুদান সরকার মার্কিন এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। একজন কর্মকর্তা বলেন, এই পরামর্শটি তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। কেউ এই বিষয়টি আর আলোচনা করেনি।
সুদানের সামরিক প্রধান জেনারেল আবদেল-ফাত্তাহ বুরহান গত সপ্তাহে কায়রোতে এক সম্মেলনে বলেন, তার দেশ ‘কোনোভাবেই’ ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা মেনে নেবে না।
সোমালিল্যান্ড
৩০ বছর আগে সোমালিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন সোমালিল্যান্ড স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো স্বীকৃতি পায়নি। হর্ন অব আফ্রিকা খ্যাত সোমালিল্যান্ডে ৩০ লাখ মানুষ বসবাস করেন। সোমালিয়া এখনো একে নিজের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে।
সোমালিল্যান্ডের নতুন প্রেসিডেন্ট আব্দিরাহমান মোহাম্মদ আবদুল্লাহি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিকে তার প্রশাসনের মূল লক্ষ্য করেছেন।
একজন মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে ‘গোপনে আলোচনা’ করছে। যেখানে পারস্পরিক স্বার্থে সহযোগিতার বিনিময়ে তাদেরকে স্বীকৃতি দেওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
সোমালিল্যান্ডের একজন সরকারি কর্মকর্তা যার গণমাধ্যমে কথা বলার অনুমতি নেই, নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি বলেছেন, তারা এ বিষয়ে কোনো আলোচনা করেননি।
সোমালিয়া
সোমালিয়া দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনিদের সমর্থন জানিয়ে আসছে। দেশটিতে প্রায়ই ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের আয়োজন করে। দেশটি সম্প্রতি আরব সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল, যেখানে তারা ট্রাম্পের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে।
নাইরোবিভিত্তিক আইনজীবী ও সংঘাত বিষয়ক গবেষক সাম্বু চেপকরির বলেন, সোমালিয়া ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার ঘোর সমর্থক হওয়ায় এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা অবাস্তব মনে হয়।
তিনি বলেন, অনেক কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। তাই এর পেছনে সম্ভবত কোনো গোপন এজেন্ডাও থাকতে পারে।
গণমাধ্যমে কথা বলার অনুমতি নেই এমন একজন সোমালিয়ান কর্মকর্তা বলেছেন যে তার দেশকে ফিলিস্তিনিদের গ্রহণ করার জন্য কোনো অনুরোধ জানানো হয়নি। এ বিষয়ে কারোর সঙ্গে কোনো আলোচনাও হয়নি।
ওএফ